সবার মধ্যে একধরণের একটা ট্যাবু কাজ করে যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপন্থী ছিল এবং রাশিয়া শুরু থেকেই বন্ধুপ্রতিম মিত্র হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু বস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। স্বাধীনতার অনেক বছর পেড়িয়ে গেছে। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত নথিপত্র আছে যার পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা এসকল পরাশক্তির ভূমিকা সম্পর্কে একটা রূপ রেখা তৈরি করতে পারি।
এসকল বিষয় উদঘাটনে আমাদের তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান থাকাও আবশ্যক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব ব্যবস্থা দুই মেরু ভিত্তিক ভাবে পরিচালিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন লিপ্ত হয় এক বৃহৎ প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বের বিষয় ছিল মতাদর্শীক এবং প্রভাব বিস্তার নিয়ে। সোভিয়ের রাশিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী প্রচারণা ও কমিউনিজম ছড়িয়ে দিতে পূর্ণ মাত্রায় সচেষ্ট হয় এবং অন্যদিক যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিজকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধে মাঠে নামে। যুক্তরাষ্ট্র সিনেটর জন ম্যাকার্থির “ঠেকানো(Containment)” নীতিতে আগাতে থাকে। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে “ভয়াবহ প্রত্যুত্তর” দিতে আগ্রহী হলেও ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধিতে তা “নমনীয় প্রত্যুত্তরে” এসে থামে। দিনদিন সোভিয়েত ক্ষমতা বেড়েই চলছিল। ১৯৬৮-৬৯ এর দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয় ছিল আন্যতম একটি ঘটনা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল জটিল এবং প্যাঁচালো। অনেকে বলে থাকেন যে, বৃহৎ শক্তিগুলোর জটিল সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক শক্তি-রাজনীতির ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। এমনকি এটাকে বাংলাদেশ -পাকিস্তান যুদ্ধ না বলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলেও অনেক আখ্যা দেন। এ ধরণের বক্তব্য শুধু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তুচ্ছার্থে প্রকাশ করা হয় এবং বাঙালিদের আত্মত্যাগ ও তিতিক্ষার ইতিহাসকে ছোট করার প্রয়াস পায়।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। এখানে প্রভাব বিস্তার করতে দুই পরাশক্তিই উদগ্রীব ছিল। ভারতের সাথে রাশিয়ার যোগসাজশ বেশি দীর্ঘ দিনের আবার পাকিস্তানের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। পাকিস্তানের মাধ্যমে ১৯৭১ এর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের “পিংপং ডিপ্লোম্যাসি” মাধ্যমে সম্পর্কন্নয়ন হয়। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বভাবতই তার প্রভাব বিস্তার করতে এবং শত্রু রাষ্ট্র চীনকে একঘরে করে দিতে ভারতের দিকে ঝুঁকে পরে। অতএব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দুইটা ব্লক তৈরি হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থনে থাকলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্ব বাংলার পক্ষে রইলো ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরুর দিকে মোটেও বাংলাদেশকে সরাসরি কোন সাহায্য দেয়নি কিন্তু পরবর্তী সময়ে জুলাইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সফরের ফলেই ৯ আগস্টে তড়িঘড়ি করেই ভারত সোভিয়েত মৌত্রি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এরপরই ভারত হয়ে বাংলাদেশে সোভিয়েত সাহায্য আসতে থাকে।
বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাটা একটু বেশিই প্যাঁচালো ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী শক্তি হয়েও এমন কোন নীতি গ্রহণ করেননি যা কিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র মোটামুটি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তার কৌশলগত কার্য সিদ্ধি করে।
৭ অক্টোবর ১৯৭০সালে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র প্যাক্টে সামরিক সাহায্যের জন্য উভয় পক্ষই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। এই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩০০টি সৈন্যবাহী বিমান,নতুন বি-৫৭, ৬টি এফ-১০৪ বিমান, ৪টি নৌ-প্রহরী বিমান ও কতিপয় প্রাণহানীকর নয় এমন সরঞ্জাম ক্রয়ের চুক্তি হয়।যার মূল্যমান ধরা হয় ৯০মিলিয়ন ডলার। ২৬মার্চের আগেই ৩৫মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সাপ্লাই দেয়া হয় কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে সম্পূর্ণ চুক্তিই স্থগিত করা হয়। অবশ্য নিক্সন পাকিস্তানকে বাগে রাখার জন্য এই নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা শিথিলতা দেখান। তবে তাও সবমিলিয়ে ৫মিলিয়ন ডলারের কম অস্ত্র ডিসেম্বর পর্যন্ত সাপ্লাই দেয়া হয় পাকিস্তানকে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ করে শুরু হলে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়।
মার্কিন নীতি বস্তুত বাংলাদেশের পক্ষেই যায়। তৎকালীন সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাৎসরিক ৯০মিলিয়ন ডলার খাদ্য সাহায্য দেয়া হত। এরমধ্যে ৫৫ মিলিয়ন ডলার যেত পিএল-৪৮০ এর অধীনে এবং বাকী ৩৫মিলিয়ন ডলার যেত নগদ অর্থে। পহেলা অক্টোবর নিক্সন প্রশাসন ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি শরণার্থীদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ এড়াতে তিনি আরও ২৫০মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত সাহায্য পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যে সাহায্য করেন এবং এর ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিপুল সাহায্য পূর্ব বাংলায় আসতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে তাকে ভিন্ন পথে হাটতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পূর্ব বাংলাকে সমর্থন দিলে বহুদিনের পুরনো মিত্র পাকিস্তানকে হারাতে হত এবং যার ফলে মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হত। অন্যদিকে এতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিত এবং পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধে ছড়িয়ে যাবার প্রবণতা তৈরি হতে পারতো। সুতরাং ওয়াশিংটন সবসময়ই পাকিস্তানের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে পাকিস্তানকে উপদেশ দেয় অন্যথায় বিচ্ছিন্ন হলেও তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে বলা হয়। সামরিক শক্তি ব্যাবহারে বহু আগে থেকেই পাকিস্তানকে নিরুৎসাহিত করতে সচেষ্ট থাকলেও পাকিস্তান তাতে কর্ণপাত করেনি।
অন্যদিকে রাশিয়া যখন একমাত্র মিত্র রাষ্ট্র ভারতকে হারাতে যাচ্ছিল তখন তার কৌশলে পরিবর্তন আসে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে এর বিরোধিতা করে ভেটো দেয়। এবং জাহাজ ভর্তি করে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ সরঞ্জাম ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রেরিত হয়। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে সোভিয়েত ইউনিয়নও পাকিস্তানের সাথে পূর্ণ যুদ্ধকালীন সময়েও সম্পর্ক রেখেছিল। এমনি যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সামরিক সাহায্য পর্যন্ত দিয়েছিল। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এটাকে আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার হেতু স্বরূপ বলে ফালাও করার চেষ্টা করে। তবে শেষ দিকে মস্কোর জোরালো সমর্থন ও সহযোগিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আরেক ধাপ এগিয়ে দেয়।
যুদ্ধের শেষ দিকে ইউএস এন্টারপ্রাইজ যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ একটি বিতর্কিত বিষয়। তবে ওয়াশিংটন এটা এমন সময় প্রেরণ করলো যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। ইউএসএ এটি একটি কৌশলগত ভূমিকা হিসেবে পাঠিয়েছিলো। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বদ ইচ্ছে থাকলে আগেই পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দিয়ে শক্তিশালী করতে পারতো। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পাকিস্তানের প্রতি অনেকটা “বন্ধু-প্রতিম মিত্রের” নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে ফুটে ওঠে। রাশিয়াও তদ্রূপ তার স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে সমর্থ হয় তাও ভারতেও চাপের মুখে। নৈতিকতার কোন স্থান ছিলনা। এমন নানামুখী জটিল সব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয়।
তথ্যসূত্র :
১.সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত “বাংলাদেশের ইতিহাস”
২.বাংলাদেশের ইতিহাসের রূপরেক্ষা
৩. বাংলা পিডিয়া।
৪.বাংলাদেশের ইতিহাস, আব্দুর রহিম।