বিশ্বের ইতিহাসে এক মহা পরাক্রমশালী সভ্যতা হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতা। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর রহস্যের গভীরে ঘেরা সেই সভ্যতা। মিশরীয় সভ্যতারই একটি রহস্যঘেরা নাম নেফারতিতি।
নেফারতিতিকে প্রাচীন মিসরের সবচেয়ে সুন্দরী ও ক্ষমতাবান রাণী বলা হয়। তার নামের অর্থ হচ্ছে “একজন সুন্দর নারী এসেছে”। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭০ সালের দিকে তার জন্ম হয় এবং ১৩৩০ খ্রিস্টপূর্ব সালে তার মৃত্যু হয়। নেফারতিতিকে নিয়ে ১৯১২ সালের আগে কেউই চিনতই না। ১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মানির একটি খননকারী দল যার নেতৃত্বে ছিলেন Ludwig Borjardt এল-আমারনা”র ধ্বংসাবশেষ থেকে কাদামাটির তৈরি একটি রেলিক খুঁজে পায়, যাতে ছিল ৩২০০ বছরের পুরনো একটি নারীর প্রতিমূর্তি। মূর্তিটি ২০ ইঞ্চির বেশী লম্বা নয়। গবেষণায় বেড়িয়ে আসে সেই প্রতিমূর্তিটিই হল রাণী নেফারতিতির। সেই রেলিকটি এখন বার্লিনের অল্টেস মিউজিয়ামে রাখা আছে।
নেফারতিতিকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাণী হিসেবে ঐতিহাসিকরা গণ্য করেন। তাকে অসংখ্য নামে ও উপাধিতে অভিহিত করা হয়েছে তাকে Ruler of the Nile এবং Daughter of Gods হিসাবে ডাকা হয়। দীর্ঘ এবং হাসের মত গলার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি গ্যালেনা উদ্ভিদ ব্যাবহার করে তার রূপসজ্জা করতেন। প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ বা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিছু মানুষের কাছে নেফারতিতি ছিলেন ধর্মত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক। আর কারো কাছে তিনি ছিলেন একজন জীবিত দেবী যিনি তার সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছিলেন তার দেশের জন্য। তিনি ছিলেন একাধারে রহস্যের রাণী, যাদুর রাণী, ভালোবাসার রাণী কিংবা হিংসাপরায়ণতা এবং প্রতিশোধের রাণী।
ধারণা করা হয় রাজা আমেনহোতেপ এর জন্য সংরক্ষিত হেরেমে বেড়ে উঠেছিলেন নেফারতিতি। ঠিক এই কারণেই তার পিতামাতার সঠিক কোন খোজ পাওয়া যায়নি। আবার কিছু তথ্যপ্রমাণ সাক্ষ্য দেয় তিনি আখমিম শহর থেকে এসেছেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা “আই” এর কন্যা অথবা ভাস্তী। এছাড়া আখেনআতেন ও নেফারতিতি সময়ের আমারনা মন্দিরে অংকিত আছে যে নেফারতিতি রাণীর বোন যাকে “মুতবেনরেত” নামে অভিহিত করা হয়েছে। আরেকটি সূত্রে জানা যায় তিনি ছিলেন তাদুখিপার মিতান্নি রাজকন্যা। মিতান্নি হল বর্তমানের সিরিয়া।
স্বামী ফারাও আখেনআতেন এর পাশাপাশি তিনিও খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ এর মাঝামাঝি সময়ে শাসন করছেন বলে ধারণা করা হয়। এই ক্ষমতা এর আগে কোন রাণীকে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয় আখেনআতেন এর মৃত্যুর পরে পরবর্তী ফারাও তুতেনখামেন এর আগ পর্যন্ত তিনি ফারাও হিসেবে শাসন করেন। মিশরের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় নারী যিনি হাটসেপুত এর ফারাও হয়েছিলেন।
কারনাকের মন্দিরের প্রবেশপথের পাশের দেওয়ালের পাথরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় একশোর মত চিত্র পাওয়া গেছে। এইসব চিত্রে নেফারতিতিকে দেখা গেছে শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হিসাবে। সাধারণত এইসব অনুষ্ঠানের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকত ফারাওদের হাতে। সেইখান থেকেই ধারণা করা হয় যে নেফারতিতি দেবীর পর্যায়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এমনকি তা ছিল ফারাওয়ের সমকক্ষ। একযুগের ও বেশী সময় ধরে নেফারতিতিই ছিলেন প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী আর ক্ষমতাশালী নারী।
একটি খণ্ডিত পাথরের লিপি উদ্ধার হলে দেখা যায়, সেখানে নেফারতিতির নাম রয়েছে। যেখানে তার নামের পাশে উৎকীর্ণ রয়েছে “গ্রেট রয়্যাল ওয়াইফ” শব্দটি যা তার সামাজিক মর্যাদা প্রকাশ করছে। এমন বেশ কিছু পাথর চিত্রে দেখা যায় নেফারতিতি যুদ্ধরথে চড়ে একটি দণ্ড উঁচিয়ে আছেন । এ থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন তিনি ছিলেন “সুপ্রিম অথরিটি অব দ্য স্টেট”। অন্য চিত্রে তাকে দেখা যায় তরবারি হাতে মিশরের শত্রুদের নিধনে ব্যস্ত।এছাড়াও রয়েছে সভ্রান্তদের মাঝে স্বর্ণপদক বিতরণের চিত্র। সব মিলিয়ে এসকল “ফ্রেসকো” থেকে যে ছবি পাওয়া যায় তা নেফারতিতিকে চিত্রিত করেছে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মিশর অধীশ্বরী হিসেবে। এ পর্যন্ত মিশরের প্রাচীন ইতিহাসে আর কোনও রাজকীয় মহিলার এমন ছবি পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় আমেনহোতেপের ছেলে আখেনআতেন এর সাথে নেফারতিতির ঠিক কখন বিয়ে হয় তা জানা যায়নি। তারা দুজন মিলে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাদের শাসনামলকে স্বর্ণযুগ ধরা হয়। মিশরের ইতিহাসে অন্যতম দয়ালু এই রাজা রাণীকে তৎকালীন জনগণের অনেকেই পছন্দ করতেন না। তার মূলে ছিল তাদের নতুন ধর্ম প্রবর্তন।
প্রাচীনকালে মিশরের ফারাওদের বহু স্ত্রী থাকত। কিন্তু রাণী উপাধি দেওয়া হত তাদেরকেই যারা কিনা যোগ্য ফারাও এর জন্য ছেলেসন্তান জন্ম দিতে পারতেন। নেফারতিতি ছয়টি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেও ইতিহাসে তার পুত্রসন্তানের কোন সঠিক হদিস পাওয়া যায়নি। তাদের মাঝে দুজন পরবর্তী রাণী হয়। মেরিতাতেন ছিল তাদের একজন।ধারণা করা হয় যাকে তার পিতা আখেনহাতের এর রাণী হিসাবেই। আরেকজন হলেন আনখেনসেনপাতেন বা আনখেনসেনামেন যিনি ছিলেন তুতেনখামেনের রাণী।
বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিকে আখেনআতেন ও নেফারতিতিকে কন্যাসন্তানদের সাথে দেখা গিয়েছে। সেখানেও পুত্রসন্তানের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাকে তুতেনখামেনের মা মনে করা হলেও গবেষণার দেখা যায় তিনি আসলে তুতেনখামেনের বায়োলজিক্যাল মাতা নন। তিনি ছিলেন তার শাশুড়ি এবং সৎ মা। তবুও কেন তিনি রাণীর মর্যাদা পেলেন এই নিয়ে ইতিহাসবিদগণের মত বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ধারণা করা হয় তার অসাধারণ রূপের সাথে অসামান্য রূপ, ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং আখেনআতেনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা এবং অগাধ সমর্থন তাকে এইআসনে অধিষ্ঠিত করে।
পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে তুতেনখামেনের মা হচ্ছেন তারা বা আখেনআতেনের আপন বোন বা তার ফুফু। এর জন্য তুতেনখামেন পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছিলেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
নেফারতিতি মোহনীয় রূপ ও বাচনভঙ্গি দিয়ে যে কাউকে বশ করতে পারতেন। হয়তো তার ওপর ভরসা করেই আখেনআতেন সবচেয়ে বড় এবং অসম্ভব বিপদসংকুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এবং আখেনআতেন সঠিক ছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন তার যোগ্য স্ত্রী রাণী নেফারতিতির এমন সমর্থন যা হয়তো তিনি আর কারো কাছে থেকে পেতে পারতেন না।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হিসাবে ফারাওরা শাসন করতেন। তারা বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ফারাও পরেই ক্ষমতাবান ছিল মন্দিরের পুরোহিতগণ। মূলত এদের দ্বারাই শাসিত হতো মিসর। তারা নানা দেবদেবীর উপাসনা করতেন। ফারাও আর পুরোহিতগণের মাধ্যমেই জনগণ ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে পারত। এই বহু ঈশ্বরবাদে পরিবর্তন আসে নেফারতিতি-আখেনাতেনের সময়। তখন মিসরে নানা দেবদেবী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা আমুন-রা এর উপাসনা হতো। কারনাকের মন্দির ছিল প্রধান উপাসনালয়। আখেনআতেন শাসনামলের তৃতীয় বছরে খুবই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আখেনাতেন আমুন-রাকে দেবতা হিসেবে অস্বীকার করেন এবং অন্যসব দেবদেবীকেও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়ে আসেন নতুন সৃষ্টিকর্তা আতেনের ধারণা। মিসরের এটাই প্রথম এলো একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা।
স্বপ্নের মাধ্যমে সেই ধর্মের খোঁজ পান আখেনআতেন। তার স্বপ্নে তিনি দেখতে পান একটি অস্তগামী সূর্য তাকে সন্তান হিসেবে ডাকছে। সেই সূর্য তাকে বলে যে সে আখেনআতেনকে ক্ষমতা দিয়েছিল। তাকে উপাসনা করতে বলে এবং তার নামে মন্দির চালু করতে বলে।
আতেন মূলত সূর্য দেবতা। আমেনহোতেপ একমাত্র দেবতা আতেনের উপাসনা করতেন। তখনই তার নাম পাল্টে আখেনাতেন হয়। আখেনআতেন মানে হচ্ছে আতেনের পুত্র। এক্ষেত্রে তার স্ত্রী নেফারতিতিও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তারা দুজনে মিলে সূর্য পূজার নতুন ধর্মের প্রচলন করেন এবং তারা দুজন ছিলেন এই ধর্মের কাণ্ডারি। তাদের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ সূর্য দেবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত। তবে নেফারতিতি অন্য দেবতাদেরও শ্রদ্ধা করতেন।
আতেন এর উপাসনার ধরন একটু অন্যরকম ছিল। এই দেবতার উপাসনা দিনের আলোতে বাইরে সবার সামনে হতো। এর আগে আমুনরার পুরোহিতরা অন্ধকার মন্দিরগুলোর ভেতরে রহস্যময় কায়দায় করতেন। সাধারণ মানুষের সেই উপাসনার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ থাকত না। নতুন দেবতা এবং নতুন উপাসনার ফলে সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণের মাঝে শুধু একটি সত্তাই রয়ে গেল। তিনি হলেন ফারাও আখেনাতেন স্বয়ং। ফলে পুরোহিতদের গুরুত্ব চরমভাবে হ্রাস পেল। উপাসনার জন্য দেবতাকে উৎসর্গের জন্য পুরোহিতরা যে অর্থ জনগণ থেকে নিতেন, সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আখেনাতেন হুকুম দিলেন কার্নাকের মন্দিরের সব জৌলুস সরিয়ে দিতে। সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে তার আদেশে আমুন-রা এবং অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা হল। ৩০০০ বছরের পুরাতন ধর্ম ও দেবদেবীদের নিষিদ্ধ করেন। রাজধানী থেবসের সব মন্দির বন্ধ করে দেন এবং এর পুরোহিতদের জেলে পুরতে থাকেন। যেসব পুরোহিত এর বিরোধিতা করেছিল তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। থেকে গেল শুধু এক ঈশ্বর আতেন বা সূর্য। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল পুরোহিতদের ক্ষোভ। পরবর্তীতে নেফারতিতির বিরুদ্ধে তারা তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
এরপর তিনি সূর্য দেবতা যাকে আতেন বলে ডাকা হত তার ধর্ম প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে পড়েন। এই স্বপ্ন তার উপর ভয়ানক-ভাবে আছর করেছিল। তাই তৎকালীন ওই যুগেও তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। আর তার এই সিদ্ধান্তের পিছনে অগাধ সমর্থন দিয়ে গেছেন রাণী নেফারতিতি। এর বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় তাতেও নেফারতিতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তবে কিভাবে তিনি এই কাজ করেন সেই বিষয়ে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায়নি।
তৎকালীন থেবসে এই ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা খুবই একটি কঠিন কাজ ছিল। ফারাওরা রাষ্ট্রের প্রধান হলেও মন্দিরের পুরোহিতগণের সাহায্য ছাড়া এ ছিল অসম্ভব। রাজধানী থেবসের আমুন মন্দিরের পুরোহিত এবং সারা শহরের অসংখ্য মন্দির বন্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই তিনি নতুনভাবে একটি রাজধানী করতে চাইলেন যেখানে একমাত্র সূর্য দেবতারই চিহ্ন থাকবে, অন্য কোন দেবতার যাতে প্রবেশ না ঘটে সেখানে।
তিনি নতুন রাজধানী হিসেবে বেছে নেন মরুভূমির একটি জায়গাকে যেখানে এক পাশে ছিল নীল নদ এবং অন্য পাশে ছিল উপত্যকা। সেই উপত্যকার দুটি পাহাড়ের মাঝে যখন সূর্য অস্ত যেত তা যেন দেবতা আতেনের এর উদ্দেশে পুরো রাজধানীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এর সমান ছিল। এবং সেই জায়গা পরিচিত হয়েছিলো “আমারনা” নামে । সেই জায়গায় প্রায় ৫০০০ মানুষের পরিশ্রমে গড়ে উঠে অনিন্দ্যসুন্দর এক নগরী। এই শহরে খোলা আকাশের নিচে এখনো কিছু সূর্য দেবের উপাসনালয় আছে।
নেফারতিতির আমলে আসে রাণীর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন রাজ্যসভায় রাণীর জন্য আলাদা আসন থাকতো না। থাকলেও তা ছোট হতো রাজার আসনের তুলনায় এবং তা খানিকটা পেছনে থাকতো। কিন্তু আখেনআতেন এর সিংহাসনের পাশেই রাণী নেফারতিতির সিংহাসনের অবস্থান এবং দুজনের একই সাথে সভা পরিচালনা ও সিংহাসনের আকার এটাই প্রমাণ করে যে তার ক্ষমতা একজন ফারাও এর সম মর্যাদার ছিল। ইতিহাসে এর আগে কোন রাণী এতো মর্যাদা পায়নি। অনেক ঈজিপ্টোলজিস্টদের ধারনা, আখেনআতেন এর অনেক সিদ্ধান্ত আসলে নেফারতিতির নেয়া এবং আমিও সম্মতি এর সাথে।
নেফারতিতি ও আখেনআতেন রাজা রাণীর জন্য প্রযোজ্য প্রটোকল ভুলে এক বিনোদন এর ব্যবস্থা হিসেবে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করেন। যেখানে রাজা ও রাণী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যা ইতিহাসে আগে কখনও ঘটে নি। মজার ব্যাপার এটা যে নেফারতিতি ই নাকি সেই প্রতিযোগিতার বেশিরভাগ জিতেছিলেন। এর সবই ছিল নেফারতিতির ক্ষমতার স্বাক্ষর।
শুধু রাজকার্য এবং ধর্মচর্চা নয়, ফারাও আখেনআতেন ও রানী নেফারতিতির আমলে চিত্রকলায় নতুন ধারা শুরু হয়। রানী নেফারতিতি এবং তার কন্যাগণের যেসব ছবি এপর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার সাথে আগের যুগের চিত্রকলার ধারার সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না।
কিন্তু হটাতই আখেনআতেনের শাসনামলের ১৪ বছর পরেই তার মৃত্যু ঘটে। ধারণা করা হয় তখন নেফারতিতি ক্ষমতায় বসেন। তবে তার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে সময় নেফারনেফারুআতেন নামে অন্য কারো সিংহাসনে বসারও আলামত পাওয়া যায়। নেফারতিতির তত্ত্বাবধানে আতেন দেবতার আখেনাতেন শহরের কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হয়। এর মধ্যেই নেফারতিতির মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।
কিছু সূত্র আবার বলে অন্য কথা। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোনও ছেলে ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। তাই নেফারতিতির মৃত্যুর পর পুরোহিতরা আখেনআতেনের অন্য রানীর আট বছর বয়সী ছোট ছেলে তুতেনখামেনকে মিসরের ফারাও নির্বাচন করেন। বালক তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসিয়ে, পুরোহিতরা সমগ্র মিসরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান। আখেনাতেন শহরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আবার পুরো দমে উপাসনা শুরু হয় কারনাকের মন্দিরে। সূর্য দেবতা আতেনের বিদায় হয় এবং আবার শুরু হয় দেবতা আমুন-রা এবং অন্যসব দেবদেবীদের উপাসনা। অনেক বিশ্লেষকেরাই মনে করেন রোগে শোকে নেফারতিতির মৃত্যু হয়নি। বরং এসব চিন্তাকারীদের ধারনা, ফারাও আখেনাতেন এর মৃত্যুর পরে নেফারতিতি চেষ্টা করে থাকবেন রাজ্যকে ধরে রাখতে। তাই তিনি বিদেশী কাউকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যা উৎকীর্ণ আছে একটি পাথরের শিলালিপিতে। শিলালিপিটি পাঠানো হয়েছিলো “হিতিস” সম্রাটের কাছে । শিলালিপিটিতে ফারাওয়ের মৃত্যু সংবাদ উল্লেখের পাশাপাশি একজন রাজপুত্রকে মিশরে পাঠানোর অনুরোধ ছিল ।“হিতিস” সম্রাট কথামতো একজন যুবরাজকে পাঠিয়েও নাকি ছিলেন যিনি পথিমধ্যে আততায়ীর হাতে নিহত হন। উদ্ধারকৃত পাথর খণ্ডের এই লিপির লেখা কাহিনী বা “থিওরি” নেফারতিতির নামের সাথে যুক্ত করেছেন এ ধরনের গবেষকরা । তাদের ধারনা সত্যিকার নেফারতিতির মমি কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সম্ভবত তার মরদেহকে মিশরের পুরোহিতরা এমন সমাধিতে সমাহিত করেছেন যা সহজে খুঁজে পাওয়া হবে দুষ্কর।
কেউবা বলেন, ফারাও আখেনআতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতি পুরুষ বেশ ধারণ করেন এবং পরবর্তী ফারাও তুতেনখামেনের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি মিশররাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদল বলেন, আখেনআতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতি ফারাও Smenkhkare উপাধি ধারণ করে মিশরের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। নেফারতিতির রাজমুকুট পরিহিত কিছু ছবি সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। আরেকদল বিশেষজ্ঞ এসকল ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ফারাও আখেনআতেনের মৃত্যুর পর একসময় পূর্ববর্তী দেবতা আমেন-রার পূজা আবার সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং রানী নেফারতিতিকে অজ্ঞাত নির্বাসনে পাঠান হয়।
আবার বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্বামী আখেনআতেনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর পরই উধাও হন রাণী নেফারতিতি।
তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে এখন পর্যন্ত এ ক্ষমতাশালী নারীর মৃতদেহ বা সমাধি নিয়ে রহস্যই থেকে গেছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ এখনো এই নিয়ে গবেষণা করছেন।
দ্বিতীয় আমেনহোতেপ এর মন্দিরে যাকে KV35 বলে সেখানে ৩ টি মমি পাওয়া যায় যার মধ্যে দুটি ছিল নারীর এবং একটি ছিল অল্প বয়সী কোন ছেলের।
একটি ছিল আখেনআতেন এর মা তুতেনখামেন এর দাদী এবং আমেনহোতেপ ৩য় এর স্ত্রী রাণী তিয়ার । আর একটি ছিল তারই ছেলে, যে অকালে মারা গিয়েছিলো প্লেগ এ আক্রান্ত হয়ে। যদিও তার নাম সঠিকভাবে জানা যায়নি ধারনা করা হয় তিনি আখেনআতেন এর ছোটভাই ছিলেন।
৩য় মমিটা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক। ডক্টর ফ্লেচার বলে একজন গবেষক ধারণা করেন মমিটা ছিল রাণী নেফারতিতির। কারণ ডক্টর ফ্লেচার এমন এক সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালান যা এর আগে কেও করেনি এবং তা হল “প্রাচীন মিশরীয় নারীদের চুল নিয়ে গবেষণা”।
প্রাচীন রানীরা বিভিন্ন পরচুলা এবং মুকুট পরিধান করতেন যা তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসব বা আয়োজনে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত করতো। এই পরচুলা এবং মুকুট নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে এক ধরনের বিশেষ মুকুট বিশেষভাবে পরলে যে অংশ দাগ পরার কথা সেটা আছে। এবং এই লক্ষ্যে তিনি মমিটাকে নেফারতিতি বলে ধারনা করে তা প্রমাণের জন্য চেষ্টা চালান যা সম্পূর্ণ নীতি বিরুদ্ধ। যদিও সেই সময় ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না।
এই মমিটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্পূর্ণ মমিটা ক্ষত বিক্ষত ছিল। কে বা কারা যেন এর মুখমণ্ডলে আঘাতের পর আঘাত করে তার একপাশ ধসিয়ে দিয়েছে। তার বক্ষজোড়া যেন কারা কেটে নিয়ে গিয়েছিলো এবং সেই মমির শরীরে কোন ব্যান্ডেজ ছিলোনা।
প্রাচীন মিশরের বিশ্বাস অনুযায়ী “যদি কোন মমিকে নষ্ট বা তাতে ক্ষত তৈরি করা হয়, তাহলে পরবর্তী জীবনে দেবতারা তাকে চিনতে পারবেন না এবং সে দেবতাদের সামনে নিজের নাম বলতে পারবেনা । এর ফলে সে মৃত্যুর পর জীবন ও মৃত্যুর জগতের মাঝে আটকা পরে যাবে ।”
এর মানে দাঁড়াচ্ছে কেউ বা কারা যেন চাচ্ছিল যে রাণী নেফারতিতি যাতে পরবর্তী জীবনে স্বর্গে যেতে না পারে, না পারে যাতে বলতে সে কে ছিল । যদিও সেই মমি আদতেও নেফারতিতির মমি ছিলোনা।
এই মমিকেই “ডক্টর জোয়ান ফ্লেচার” নেফারতিতির মমি প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং ব্যর্থ হোন এবং ভুল পথে গবেষণার জন্য তাকে বর্তমানে মিশরে গবেষণার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়েছে।
রহস্য আরও ঘনীভূত যখন ধারনা করা হল, ১৯৩৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কিশোর তুতেনখামেন ফারাও পদে বহাল হলে তিনিই তার পিতা আখেনআতেন আর তার স্ত্রী নেফারতিতির গড়া সমস্ত সৌধ, মন্দির সহ যাবতীয় স্মৃতি ধ্বংস করে ফেলেন। কারণ ও আছে। কারো কারো ধারনা, নতুন ধর্ম প্রচার কালে নেফারতিতি প্রাচীন ধর্মের মন্দিরগুলো ভাঙ্গার পাশাপাশি “কিয়া” নামের আখেনআতেন এর বোন গড়া স্তম্ভগুলোও ভেঙ্গে ফেলেন। আর তুতেনখামেন হলেন কিয়ার সন্তান। আর তাই নেফারতিতির মমিটি ফারাওদের সমাধিস্থলে পাওয়া যাবেনা প্রতিহিংসার কারণেই। সেই তৃতীয় মমিটির ধ্বংসের পিছনে হয়তো তুতেনখামেনেরই হাত ছিল।
ঈজিপ্টোলজিস্ট এর ধারণা এই যে ,নেফারতিতির পিতা “আই” যিনি তুতেনখামেনের পরে ফারাও হয়েছিলেন তার নেপথ্য হাত ছিল তুতেনখামেনের রহস্যময় মৃত্যুতে। হয়তো আই তুতেনখামেনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নেশায়ই এই কাজ করেছিল।
রাণী নেফারতিতি নিজের প্রধান রাণীর ক্ষমতা রক্ষা করতে কোন এক সময় তুতেনখামেন এর মা এবং তার স্বামী আখেনআতেন এর বোন ও স্ত্রী “The Younger Lady” কে হত্যা করেন।
অথবা গবেষকরা দেখেছেন সেই নারীর মৃত্যু হয় সে জীবিত থাকা অবস্থায় এবং তার বুকের বামদিক দিয়ে ছুরির ঘা এর দাগ থেকে তা প্রমাণিত হয় । কিন্তু মমিফিকেশন এর অনেক পরে তার মুখমণ্ডলের উপর আঘাত করা হয় । এবং বক্ষ ছিন্ন করে ফেলা হয় । যা প্রমাণ করে সেই মমি জীবিত শত্রু ছিল।
কারো কারো মতে সেই খুন নেফারতিতি সংঘটিত করেন অথবা কাউকে দিয়ে করিয়ে নেন। এবং কোনভাবে সেই লাশকে নিজের নামে চালিয়ে দেন। কারণ সেই মমির মৃত্যুর সময়কাল রাণী নেফারতিতির গায়েব হওয়ার সময়কাল এক ছিল। এবং এই ধারনার সাথে আরও বেশ কিছু ঈজিপ্টোলজিস্ট সমর্থন দিয়েছেন। তারা তাদের জার্নালেও একই কথা উল্লেখ করেছেন।
একেকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন এক এক কথা। কারো কথা থেকে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, আসলে মমিটি কার।
নেফারতিতির যাই ঘটুক এরপর কে বা কারা যেন নেফারতিতির সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিল। তারা নেফারতিতির ছবি অঙ্কিত সবকিছু খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছিল। “কারনাক” মন্দিরে তার ও আখেনআতেন এর নামের মন্দির ও থামগুলোর ইট একটা একটা করে তুলে ফেলেছিল। তার কোন চিহ্ন যেন কেউ বা কারা যেন রাখতে চায়নি।
তাদের স্মৃতির আমারনা শহরকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে প্রতিটা ইট ধ্বংস করে দেয়া হয়। নেফারতিতির চিহ্ন আছে এমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকেনি শুধুমাত্র আখেনআতেন এর সমাধি ছাড়া। সেখানেও হামলা চললেও সেটা বেশি দূর চলেনি। কারণ হিসেবে বলা যায় মিশরীয়রা ফারাওদের দেবতা হিসেবে দেখত এবং তাদের অভিসম্পাত এর ভয় করতো।
তবে নেফারতিতির পেছনে করা সব ষড়যন্ত্রের মুল হোতা যে আমুন মন্দিরের পুরোহিতদের তার ধারনা পাওয়া যায়। কারণে তাদের অনুমতি ছাড়া সমাধিতে ঢুকে তার ক্ষতি করা সাধারণ কারোও পক্ষে সম্ভব না। আর সমাধি চোরেরা মমির কখনও কোন ক্ষতি করেনি। কারণ তাদের কাছে সেগুলো কোন মূল্য রাখতনা।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে তুতেনখামেনের সমাধির দেয়ালের স্ক্যান করা ছবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যেয়ে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভস দেয়ালের গায়ে গোপন দরজার নকশা দেখতে পান। পরে আরও সূক্ষ্মভাবে স্ক্যান করে দেখা যায় উক্ত দেয়ালের পাশে ফাঁকা জায়গা রয়েছে যা কোন আলাদা কক্ষ হতে পারে। নিকোলাস রিভস মনে করেন, তুতেনখামেনের সমাধিস্থল সর্বপ্রথম রানী নেফারতিতি দখল করেন এবং সমাধির দেয়ালের অপর পাশেই নেফারতিতি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন।
রহস্য ঘনীভূত হয় নেফারতিতির খোঁজ দেওয়া সেই মূর্তি থেকেও। সেটির এক চোখ তখনো আকা হয়নি। কি এমন হয়েছিল যে সেটি শেষ করা হয়নি।
এমনই অনেক প্রশ্নের জন্য নেফারতিতি এক রহস্য হয়ে আছে এখনো। প্রশ্নের উত্তরের জন্য গবেষণা চলছে মিশরের পিরামিড গুলোসহ সম্ভাব্য সব স্থানে।
হয়তো রহস্য অনুসন্ধানকারীরা একদিন নেফারতিতির মমি খুঁজে পাবে। তার আগ পর্যন্ত নেফারতিতির অন্তর্ধান এক রহস্যই হয়ে থাকবে। এই রহস্যের কারণেই হয়তো এত বছর পরেও আমরা তাকে মনে রেখেছি, রাখবো আরও বহু বছর।
তথ্যসূত্রঃ
en.wikipedia.org/wiki/Nefertiti
www.ancient-egypt-online.com/queens-of-egypt.html
www.biography.com/people/nefertiti-9421166
www.ancient.eu/Egyptian_Book_of_the_Dead/
www.ancient-origins.net/unexplained-phenomena/mysterious-disappearance-nefertiti-ruler-nile-001988
www.britannica.com/biography/Nefertiti
The Real Story of Mysterious ‘Queen Nefertiti
banglahub.com.bd/nefertiti/
www.somewhereinblog.net/blog/GSA1953happy/29413945
Mysterious Ancient Egypt : প্রাচীন মিশরীয় ইতিকথা ও রহস্য