বর্ণকে স্থির রাখার জন্য বানানের প্রয়োজন । বিধিবহির্ভূত বানান বর্ণের শ্লীলতাহানি ঘটায় । বাংলা বানানকে তাই সুস্থিত ও সুশৃঙ্খল করার মানসে অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে প্রথম প্রয়াস দেখা যায় ন্যাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেডের বাংলা বানান নিয়ে বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে । তিনি সর্বপ্রথম বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত পূর্ণাঙ্গ ব্যকরণ বই “A Grammar of the Bengali Language” (মুদ্রন ও প্রকাশকাল- ১৭৭৮) প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা বানানের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন । বলা হয়ে থাকে, ব্যকরণ হলো ভাষার সংবিধান । আর ব্যকরণকে ছকে রাখার বিধিবদ্ধ প্রয়োগ হলো বানান । ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততা হলো উচ্চারণ এবং বানান হচ্ছে তার বিধান ।
পরবর্তীতে হ্যালহেডের বইতে বাংলা উদাহরণ ছাপার জন্যে চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার বাংলা বর্ণমালাকে ছাঁচে ঢালেন । সম্ভবত সেদিন থেকেই শুরু হয় বাংলা বর্ণমালার আধুনিক রূপায়ণ । ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভাষাবিদরা বাংলা ভাষার বানান নিয়ে চিন্তা করে আসছেন । ছাঁচে ঢালাই করা বাংলা বর্ণমালার আধুনিক রূপায়ণ থেকে শুরু হয় বাংলা বানানের যাত্রা । বস্তুত বাংলা বানানের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য যে, মান ভাষার জন্য মান বানান অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু চরম অর্থে ‘শুদ্ধ’ বলে গ্রাহ্য করাটাও পরম বিবেচ্য নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসংগে মনে করেন, ‘বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই চলে’ ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বাংলা বানান রীতি
বাংলা বানানের বিধান প্রণয়নে সর্বপ্রথম দায়িত্ব পালন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত বাংলা বানান সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় । সামান্য কিছু পরিবর্তনের পর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় । এই নিয়ম বর্তমানে আধুনিক বাংলা বানানের নিয়ম বলে বিবেচিত হয়েছে । নিম্নে এই বিধানের কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো :
সংস্কৃত
১. রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব প্রয়োগ
২. সন্ধিতে ঙ্-স্থানে ং প্রয়োগ
অসংস্কৃত (তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দ)
১. রেফের পর ব্যাঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব প্রয়োগ
২. শব্দের শেষে (্) হস্-চিহ্ন না দেওয়ার বিধান
৩. মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হবে
৪. জ, য : এই সকল শব্দে ‘জ’ না লিখে ‘য’ লেখা ভালো
৫. ণ, ন : অ-সংস্কৃত শব্দে কেবল ‘ন’ হবে । তবে ক্ষেত্রবিশেষে ‘ণ’ লেখা হয়ে থাকে যেমন ‘রাণী’
৬. সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝানোর জন্য অতিরিক্ত (ো) ও-কার, ঊর্ধ্ব-কমা বা অন্যান্য চিহ্ন ব্যবহার যথাসম্ভব বর্জনীয় যদি অর্থগ্রহণে বাধা দেয় তবে কয়েকটি শব্দের অন্ত্য-অক্ষরে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব-কমা বিকল্পে দেওয়া যেতে পারে ।
৭. ং, ঙ : বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন প্রভৃতি শব্দ এভাবে লেখা হবে : বাংলা>বাঙলা, বাঙালী, ভাঙন প্রভৃতি
জাতীয় শিক্ষক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বানান রীতি
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশভাগের পর কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সেই প্রচেষ্টা সফল হয় নি । এই অঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের কতিপয় আমলা ও সুশীল শ্রেণির বিমাতাসুলভ আচরণের প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন হলেও বানান সংস্কারের জন্য ছিলো ক্ষুদ্র মহল । ফলে বাংলা বানানের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলকে দীর্ঘদিন কলকাতামুখী হয়ে থাকতে হয়েছে ।
কিন্তু কলকাতামুখী বানানে বিভ্রান্ত শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পাঠ্যপুস্তকে বানানের সমতা আনয়নের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয় । এই কমিটি বানানের অভিন্ন রীতি অনুসরণ করার জন্য কতিপয় নীতি দাঁড় করায় । পরবর্তীতে বানানের এই নীতিমালা কিছুটা অসম্পূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞ-পর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বানানের সুশৃঙ্খল বিধানের লক্ষ্যে একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করে । এই কর্মশিবিরে প্রবীণ আধ্যাপক, ভাষা-বিশেষজ্ঞ, সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক, শিক্ষা-প্রশাসক, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষের প্রতিনিধি এবং বাংলা একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড-এর প্রতিনিধিরা আংশগ্রহণ করেন । এই কর্মশিবিরে প্রাথমিক স্তরে পাঠ্যপুস্তকে অনুসরণের জন্য সকলের মতামতের ভিত্তিতে কতিপয় সুপারিশ প্রণয়ন করা হয় এবং চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয় ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকসমূহে বর্তমানে এই বানান-রীতি অনুসৃত হচ্ছে ।
১. রেফের পরে দ্বিত্ব প্রয়োগ হবে না
২. সন্ধিতে প্রথম পদের শেষে ম্- থাকলে ক-বর্গের পূর্বে ম্-স্থলে ং হবে । অন্যান্য ক্ষেত্রে ক, খ, গ, ঘ ও ক্ষ-এর পূর্বে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করার জন্য সর্বত্র ঙ্ লেখা হবে
৩. হস্-চিহ্ন ও ঊধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জনীয়
৪. যেসব শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর উভয় স্বর অভিধানসিদ্ধ, সেক্ষেত্রে এবং অ-তৎসম ও বিদেশি শব্দের বানানে শুধু হ্রস্ব স্বর প্রযুক্ত হবে
৫. ক্ষ-বিশিষ্ট সকল শব্দে ক্ষ অক্ষুণ্ন থাকবে
৬. ভাষা ও জাতির নামের শেষে (ি) ই-কার থাকবে
৭. কয়েকটি স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে (ী) ঈ-কার থাকবে
৮. বিশেষণবাচক ‘আলি’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে (ি) ই-কার থাকবে
৯. পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে (ি) ই-কার হবে
১০. অর্থভেদ বোঝানোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর ব্যবহার করা হবে
১১. বাংলা ভাষায় প্রচলিত কৃতঋণ বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে লেখা হবে
ক. ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত আরবি শব্দে ‘যোয়াদ’ ও ‘যাল’-এর জন্য য (ইংরেজি ‘Z’ শব্দের ব্যবহার প্রণিধানযোগ্য) ব্যবহৃত হবে
খ. অনুরূপভাবে ‘সোয়াদ’ ও ‘সিন’ এর জন্য স এবং ‘শিন’ এর জন্য শ হবে
গ. ইংরেজি এবং ইংরেজির মাধ্যমে আগত ‘S’ ধ্বনির জন্য ‘স’ ও ‘sh’, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার হবে
ঘ. ইংরেজি বক্র ‘a’ এর ধ্বনির জন্য শুরুতে ‘এ’ ব্যবহার করতে হবে
ঙ. ‘Christ’ ও ‘Christian’ বাংলা রূপ হবে খ্রিস্ট ও খ্রিস্টান । এরূপে খ্রিস্টাব্দ হবে
১২. পদান্তে (ঃ) -বিসর্গ থাকবে না
১৩. যে শব্দটি ক্রিয়াপদ সেই শব্দের বানানে পদান্তে (ো) ও-কার হয় না ।
১৪. ব্যঞ্জনবর্ণে (ু) উ-কার, (ূ) ঊ-কার, (ৃ) ঋ-কারের একাধিক রূপ ব্যবহার করে এই কারগুলো বর্ণের নিচে যুক্ত করা হবে
১৫. যুক্তব্যঞ্জন স্বচ্ছ করার জন্য প্রথম বর্ণ ক্ষুদ্রাকারে ও পরবর্তী বর্ণ বৃহদাকারে লিখতে হবে
বাংলা একাডেমি প্রণীত বানান রীতি
বাংলা একডেমি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে বাংলা বানানকে সুসজ্জিত একটি ছকে বাঁধার লক্ষ্যে গতাগতিক রীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটি রীতি দাঁড় করায় । যার ‘পরিমার্জিত সংস্করণ’ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় । বাংলা একাডেমি প্রণীত বাংলা বানানের নিয়মগুলো আলোচনা করা হলো :
তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ক্ষেত্রে :
১. বাংলা ভাষায় আগত সংস্কৃত শব্দ অপরিবর্তিত থাকবে
২. তবে যেসব শব্দে ই, ঈ বা উ, ঊ কিংবা (ি), (ী), (ু), (ূ) উভয়ই শুদ্ধ সেসব শব্দে ই বা উ কিংবা তার (ি) বা (ু) প্রাধান্য পাবে
৩. রেফ-এর পর দ্বিত্ব প্রয়োগ নেই
৪. ক, খ, গ, ঘ পরে থাকলে অন্তস্থিত ম্-স্থানে ং লেখা হবে
অ–তৎসম শব্দ (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দ)
১. ই, ঈ, উ, ঊ: সকল অতৎসম শব্দে কেবলমাত্র ই, উ বা (ি) বা (ু) ব্যবহৃত হবে
২. ক্ষ: ক্ষুর, ক্ষীর, ক্ষেত শব্দগুলো খুর, খির, খেত না লিখে উল্লিখিত সংস্কৃত বানানে লিখতে হবে
৩. মূর্ধন্য ণ, দন্ত ন: এক্ষেত্রে ণত্ব বিধান দ্রষ্টব্য । ণত্ব বিধানের ‘ণ’ সংশ্লিষ্ট নিয়মগুলো তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না ।
৪. শ, ষ, স: এক্ষেত্রে ষত্ব বিধান দ্রষ্টব্য । বাংলা ভাষায় ষত্ব বিধান সংস্কৃত শব্দের বানানে সার্থক এবং অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ।
৫. জাতিবাচক ও ভাষাবাচক শব্দে সবসময় (ি) ই-কার ব্যবহৃত হবে
৬. বিদেশি শব্দে (ি) ই-কার ব্যবহৃত হবে ।
বাংলা একাডেমি প্রণীত রীতির অতৎসম শব্দে বাংলা বানানের ৩ ও ৪ নম্বরটি বোঝার জন্য ণত্ব ও ষত্ব বিধান পড়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে ।
বাংলা বানান আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব প্রয়োজনীয় অংশ । জাতীয় জীবনে বানানবিভ্রাট ভাষার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় সংকট । সুতরাং আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জীবনে শুদ্ধ বানান ব্যবহারে পারদর্শী হওয়া উচিৎ । ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির প্রকোপে বাংলার ব্যবহার লোপ পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে । সেই অনুসারে বর্তমানে বাংলা একাডেমিকে ‘বাংলা বানানের রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করা হয় । কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রণীত বাংলা বানানের বিকৃত ব্যবহারে বিশ্বসম্ভারে বাংলা ভাষার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয় । যে ভাষার জন্য ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনে প্রাণ হারান সালাম, রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বার, যে ভাষার জন্য ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে আসামের শিলচরে রেলস্টেশন চত্বরে কুমুদ, সুনীল, সুকোমল, চণ্ডীচরণ, তরণী, হীতেশ, বীরেন্দ্র, সত্যেন্দ্র, কানাই, বর্তমানে সেই ভাষার বিকৃত ব্যবহার প্রমাণ করে আমাদের ক্ষুদ্রতা, দৈন্যতা । এই দৈন্যতা দূর করতে সকলের বাংলা বানান ব্যবহারে সচেতন হওয়া উচিৎ ।
buy generic lamisil over the counter – buy forcan without prescription buy griseofulvin sale