আধুনিক বিশ্বে জাতি রাষ্ট্রের উত্থান হওয়ার সাথে সাথেই পুরাতন সব রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে থাকে। ফলে পুরাতন নগর রাষ্ট্রের স্থলে জাতি রাষ্ট্রের উত্থান হয়।কোরিয়ার ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। কোরিয়াও দীর্ঘদিন অন্যদের দ্বারা শাসিত হবার পর কোরীয় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং জন্ম নেয় উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া নামক দুইটি পৃথক রাষ্ট্রের। ফলে শুরু হয় দুই কোরিয়ার মধ্যে আলাদা শাসন ও অর্থব্যবস্থা ।
উত্তর কোরিয়ায় একনায়ক-তান্ত্রিক শাসনের পাশাপাশি পারমাণবিক প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বিশ্ব গণমাধ্যমের আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাছাড়া মার্কিনীদের সাথে উত্তেজনার জের ধরে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসে। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন থেকে যায় যে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের মত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরাশক্তির বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার মত ক্ষুদ্র দেশের বিরোধের কারণ কি? তাছাড়া উভয়ের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্ব হাজার হাজার মাইল। আর দুই কোরিয়ার মধ্যে বিদ্যমান বিভেদের কি হবে? তারা কি কোন দিন আবার একত্র হবে? এসকল প্রশ্নের উত্তর এবং উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে থাকছে এবারের আলোচনায়।
কোরিয়ার পূর্ব–ইতিহাস:
বিশ্বের অন্যান্য সকল রাষ্ট্রের ন্যায় কোরিয়ারও নিজস্ব প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ গতিধারায় নানা ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে বর্তমান কোরিয়ার জন্ম-হয়েছে। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এসে কোরিয়া দুই ভাগ হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে রূপ লাভ করেছে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে দুই কোরিয়ার ইতিহাসই অভিন্ন।
যখন থেকে কোরিয়া উপদ্বীপের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ঠিক তখন থেকেই কোরিয়ার অধিবাসীরা ছিল কৃষি ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় এখানেও লোহা/ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। খ্রিষ্টীয় ৫ম শতকের দিকে এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি উপজাতি গোষ্ঠীর উত্থান হয়। ফলে কোরিয়া উপদ্বীপের শাসন কাদের হাতে থাকবে এজন্য এখানকার উপজাতিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ দেখা দেয়। এরই সূত্র ধরে এখানে অন্য সকল উপজাতি গোষ্ঠীদের পরাজিত করে ৬৬৮ সালে সিলা নামক এক গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে এবং শুরু হয় এ অঞ্চলে কেন্দ্রাংশ শাসন। তারা ৯৩৫ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখে। এর-পরবর্তী সময়ে তাদের কে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে “গরিইয়ো” সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে চীনাদের প্রভাব সবচাইতে বেশি ছিল। তারা দীর্ঘকাল ক্ষমতা ভোগ কারার পর ১৩৯২ সালে তাদের শাসনাবসান হয়। তাদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় “জোসোন” বংশের হাতে। এই জোসানদের আমলেই কোরিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের স্থলে চীনের কনফুসিয়াস ধর্মমত আধিপত্য লাভ করে। ফলে কোরিয়ায় সরাসরি চীনের প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করে। ১৯১০ সালে কোরিয়া জাপানের অধীনে যাওয়ার আগে পর্যন্ত জোসানদের হাতেই কোরিয়ার শাসনভার ছিল। ফলে ১৯১০ সালে জোসান বংশের পতন হয় এবং কোরিয়া হতে চীনের প্রভাব বিলুপ্ত হয়।
জাপান শাসনের অধীনে কোরিয়া:
কোরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চীনা মদদ-পুষ্ট জোসানদের দুঃশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোরিয়ার সাধারণ জনতা সোচ্চার হয়। ফলে তারা তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে ও চীনাদের আন্দোলন শুরু করে। ফলে তাদেরকে দমানোর জন্য তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এদিক দিয়ে আন্দোলনকারীদের জাপান মদদ দিতে থাকে ফলে কোরীয় উপদ্বীপে বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়। এর মধ্যদিয়ে আবার কোরিয়া কে কেন্দ্র করেই ১৯০৫ সালে রুশ-জাপান সংগঠিত হয়। এতে জাপান জয় লাভ করে। ফলে কোরিয়ায় সরাসরি জাপানের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং ১৯১০ সালে সরাসরি কোরিয়া দখল করে জাপানের অধীনস্থ করে ফেলে। এরই মধ্যে সেখানে জোসানদের কে পরাজিত ও বিতাড়িত করে জাপানের আনুগত্য গোষ্ঠী ক্ষমতা গ্রহণ করে নেয়।
এর পরবর্তী সময় হতে কোরিয়ায় সরাসরি জাপানি শাসন চলতে থাকে। তারা কোরিয়াকে ব্যবহার করে ব্যাপক শিল্প সমৃদ্ধি গড়ে তোলে। অপরদিকে স্বাধীনতাকামী কোরীয় জনসাধারণ জাপানের এই ধরনের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জাপান শাসক গোষ্ঠী স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে শান্তি বিনষ্টকারী, দেশদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এসব স্বাধীনতাকামীদের চীনের এজেন্ট বলেও উল্লেখ করে জাপানিরা। এসব স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করে জাপান। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধ কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তারা জাপান শাসকের খড়গ হস্তে থেকে রক্ষা পাবার জন্য চীনে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে বিদেশী সরকার গড়ে তোলে। কিন্তু এই বিদেশী সরকার অনেক চেষ্টা তদবির করেও আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করতে পারেনি।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর জাপানের আগ্রাসী নীতি রুখে দেয়া ও কোরীয় উপদ্বীপের জাপানি উপনিবেশগুলো কি হবে তা নির্ধারণ করান জন্য ১৯৪৩ সালে কায়রোতে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের রাষ্ট্রপ্রধানরা একত্রিত হয়। সেখানে কোরিয়াকে স্বাধীনতা দান ও সেখান হতে জাপানকে বিতাড়িত কারার প্রস্তাব গৃহীত হয়।পরবর্তীতে তেহরান সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নও এই প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হাতে জাপান পরাজিত হয়ে কোরিয়া হতে বিদায় নেয়। এসময়ই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নামের দুইটি শহর মার্কিন পারমাণবিক বেমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যা জাপানের মেরুদণ্ড কে পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে দেয়। আর এভাবেই কোরিয়া হতে জাপান শাসনের চির অবসান হয় এবং ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট কোরিয়াকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে উত্তর কোরিয়া:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়ে জাপানকে পরাজিত করার লক্ষ নিয়ে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত উভয়েই কোরিয়ায় অবস্থান নেয়। কিন্তু যুদ্ধোত্তর কালে কোরিয়ার শাসন ব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয় কেননা মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র চায় কোরিয়ায় তার অনুসারী হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। অপরদিকে সোভিয়েত চায় কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। অর্থাৎ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব স্পষ্টতা লাভ করে। ফলে দুই শক্তির প্রতিযোগিতায় কোরিয়া বলির পাঠায় পরিণত হয়ে ৩৮ ডিগ্রি সমান্তরাল রেখায় বিভক্ত হয়ে পরে। অর্থাৎ কোরিয়া দুই ভাগ হয়ে যায়। কোরিয়ার দক্ষিণাংশে মার্কিনীদের অনুসরণে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে উত্তরাংশে সোভিয়েতদের অনুকরণে কিম-জং ইলের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার পথ চলা শুরু হয়।
কিন্তু এসময় উভয় অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আক্রমণের আশঙ্কায় দিনাতিপাত চলতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার উপর আক্রমণ করে বসে ফলে শুরু হয় কোরীয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিনীরা দক্ষিণ ও সোভিয়েত উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নিয়ে সাহায্য করতে থাকে। ফলে রুশ-মার্কিন প্রক্সিওয়ারের রূপ লাভ করে। যুদ্ধের শুরুর দিকে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় সমগ্র অংশ দখল করে ফেলে। ফলে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পরে এবং কৌশলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের কে পিছু হঠতে বাধ্য করে। এদিকে উত্তর কোরিয়া সাহায্যে চীনা বাহিনী যোগ দিলেও কোন লাভ হয়নি। উত্তর কোরীয় সৈন্যদের কে ৩৮ ডিগ্রী রেখার উপরে নিয়ে যাওয়ার পর মার্কিনীদের কৌশলে ১৯৫৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর থেকে উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক কায়দায় শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে।
উত্তর কোরিয়ায় কিম ইল সুং এর নেতৃত্বে শাসন চলতে থাকে। তিনি সকল সম্পদের উপর ব্যক্তি মালিকানা বিলুপ্ত করে দেন। কল-কারখানাসহ সকল সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ থাকার পরও উত্তর কোরিয়া আশানুরূপ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারেনি। এর পিছনে অন্যতম কারণ হল দুর্নীতি। কিম ইল সুং সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন। তার পর ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র কিম জং ইল। তার সময়ে ব্যাপক বন্যার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ফলে এতে কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। তার সময়ে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক যুগে প্রবেশ। ২০০২সালে সর্বপ্রথম তাদের বিরুদ্ধে জর্জ ডব্লিউ বুশ গণ বিধ্বংসী অস্ত্র রাখার অভিযোগ তোলে প্রথমদিকে উত্তর কোরিয়া তা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে ২০০৫ সালে নিজেদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করে নেয়। এসময় তারা দাবী করে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তাদের এই পারমানবিক অস্ত্র দরকার।
পারমানবিক যুগে উত্তর কোরিয়ার প্রবেশ ও পরবর্তী ইতিহাস:
কিম জং ইলের শাসনের শুরু থেকেই তিনি সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর উপরে জোর আরোপ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি পারমানবিক প্রকল্প শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।সর্বপ্রথম ২০০৫ সালে উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক প্রকল্পের কথা স্বীকার করে এবং এর পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। এতে সমগ্র বিশ্ব উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে এবং এতে উত্তর কোরিয়াও নিজেদের কে পারমানবিক দেশের কাতারে নিয়ে যায়। কিন্তু এতে উত্তর কোরিয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এসব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিম জং ইল নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেন নি। যদিও এসময় উত্তর কোরিয়ায় অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা দেয়।
২০০৮ সালের দিকে ইলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উত্তরাধিকার বিষয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এসময় তার তৃতীয় পুত্র কিম জং উন তার অনুপস্থিতে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে। এর মধ্যেই ২০০৯ সালের ২৫ শে মে উত্তর কোরিয়া দ্বিতীয়বারের মত পারমানবিক পরীক্ষা চালায় এবং এটি ছিল সফল পারমানবিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার কারণ হিসেবে অধিকাংশের মতামত হল -নিজেদের সংকট-কালীন সময়েও উত্তর কোরিয়া পারমানবিক অস্ত্র গবেষণা থেকে পিছপা হয়নি তা প্রমাণ করতেই এই পারমানবিক পরীক্ষা চালায়। ২০০৯ সালের জুনেই ঘোষণা দেয়া হয় যে কিম জং ইলের পর কোরিয়ার নেতৃত্ব দিবেন কিম জং ইলের তৃতীয় ছেলে কিম জং উন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুর পর ২৮ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে কিম জং উন কে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
কিম জং উনের উত্থান:
কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করার পর পরই তার নিকটতম সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের কে হত্যা ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে সরিয়ে তার শাসনের পথকে কণ্টক-মুক্ত করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উনের রাজনৈতিক হত্যার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে এতে দেখা যায় যে ২০১১ সাল হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কিম জং উন সর্বমোট ৩৪০ জনকে বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ।যাদের মধ্যে ১৪০ জনই সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাকিদের মধ্যে তার নিকট আত্মীয় ,ভাই ও তার শাসনের জন্য বাধা হতে পারে এমন লোকজন অন্যতম।
কিম জং উন শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেছিলেন যে কিম তার বাবার মত শক্ত-হাতে রাজ্য শাসন করতে পারবেন না এবং তার হাতেই হয়ত উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের এককেন্দ্রিক শাসনের অবসান হতে পারে।কিন্তু কিম সকল সম্ভাবনা কে উড়িয়ে দিয়ে কঠোর হাতে শাসন শুরু করেন। তিনি একদিকে যেমন তার সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেন অপরদিকে রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদসমুহ নিজেই দখল করে নেন। ফলে অতি দ্রুতই কিম উত্তর কোরিয়ার সার্বভৌম শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। অপরদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক প্রকল্প ও সামরিক সক্ষমতা কে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তার সময়ে উত্তর কোরিয়া বেশ কয়েকবার পারমানবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। তার নেতৃতেই হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালানো হয় এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রকে আন্ত মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের কাতারে নিয়ে যায়। যা প্রায় সাত হাজার কি.মি দূরের লক্ষবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম। ফলে এখন উত্তর কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত করার জন্য সক্ষমতা লাভ করে। যা মার্কিন-উত্তর কোরিয়ার স্নায়ুযুদ্ধকে আরও ঘনীভূত করে।আর উনের এসব কার্যক্রম মার্কিনী সহ সমগ্র বিশ্বের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েই করতে হয়েছে।
শুরুর দিকে অনেকে উনের এই কার্যক্রমকে পাগলামি ও আত্মহত্যার সামিল বলে মনে করলেও বর্তমানে অনেকেই মনে করছে যে উনের নেতৃত্বেই উত্তর কোরিয়ার প্রভাব পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা গত মাসেই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার শাসকদ্বয় বৈঠক করেছে। যাকে অনেকেই মনে করছে এটি উনের একধরনের সফলতা। তাছাড়াও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও তার ঐতিহাসিক বৈঠক ইতিমধ্যে হয়ে গেছে।তাই এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বর্তমানে কিম জং উন কঠোর হাতে যোগ্য একনায়কের ন্যায় শাসন কার্য পরিচালনা করছেন।
উত্তর কোরিয়া সকল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তাদের পারমানবিক প্রকল্প ও সমাজতন্ত্রের নামে একনায়ক-তান্ত্রিক শাসন পরিচালনা করে যাচ্ছে। দুই কোরিয়া ভাগ হওয়ার পর হতে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশ কয়েকজন শাসকের হাতে ক্ষমতার হাত বদল হলেও উত্তর কোরিয়ায় এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন শাসকের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। এই হাত বদল আবার অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রেই হয়েছে। ফলে এখানে যেমন সাধারণ জনগণ রাজনীতির বাইরে ছিল তেমনি এখানে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার ব্যাপকভাবে হরণ করা হয়েছে। তারা সমগ্র বিশ্বের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থেকেও শুরুতে রাশিয়া ও পরে চীনের সহায়তায় বর্তমানেও টিকে রয়েছে।
জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোন কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না চীনের ভেটো পাওয়ার থাকার কারণে। তবে অনেকে আবার মনে করেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নব্য ঘাটি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যখানে ব্যালেন্স অব পাওয়ার রক্ষায় উত্তর কোরিয়ার মত এমন একটি দেশ থাকার দরকার রয়েছে। তবে যে যাই বলুক না কেন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা ও উনের একরোখামী আচরণ সত্যিই শান্তিকামী মানুষের মনকে সর্বদা উৎকণ্ঠার মধ্য রাখে। তাই শান্তিকামী বিশ্ব মাত্রই উত্তর কোরিয়া সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়।