১৯০৪ সাল। বাংলা ভাগ হওয়ার এক বছর বাকি। এক বছর বাকি থাকতেই ব্রিটিশ সরকার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে দুই বাংলার দৃশ্যমান উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষার। অবহেলিত পূর্ববঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিবে তারা, এমনটাই আপাতত তাদের পরিকল্পনা। দুখিনী পূর্ব বাংলায়ও যেন মুখিয়ে আছে। পশ্চিমবাংলার দাদাবাবুরা সব পেয়ে বসে থাকবে তা তো হয়না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ঢাকা শহর সরগরম হয়ে ওঠে সভা, সেমিনার এমন নানা অনুষ্ঠানে। রাস্তার পাশে, যেখানে একটু ভদ্রসমেত জায়গা পাওয়া যায় সেখানেই হয়ে যায় পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মোড়লদের আনাগোনা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এই এলাকায় যদি একটি ভাল মানের কনফারেন্স হল বা সেমিনার কক্ষ থাকত তবে হয়তো সাবলীলভাবে সবকিছু চালিয়ে নেয়া যেত। পরক্ষণেই ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে একটি কনফারেন্স হল নির্মাণের দাবি উঠে। এ দাবি কানে যায় ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের। তারাও আর দেরি করতে চায়না। পূর্ববঙ্গের মানুষগুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে এই বুঝি মোক্ষম সুযোগ যায়।
ফেব্রুয়ারি ১৯, ১৯০৪ সাল। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন রমনা এলাকায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এক ভাবী সুদৃশ্য ভবনের। যার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯০৮ সালে। লর্ড কার্জনের নামানুসারে এই ভবন পরিচিতি পায় কার্জন হল নামে। আজো ঢাকার বুক চিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার অন্যতম সেরা এই স্থাপনা।
ইতিহাস
কার্জন হল মূলত কি কারণে নির্মিত হয়েছিল ইতিহাসবিদদের কাছে এ নিয়ে রয়েছে বেশ দ্বিমত। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার মতে, কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল মূলত একটি টাউন হল হিসেবে। উনিশ শতকের শেষদিক হতে শুরু হওয়া ঢাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির জন্য এই টাউন হলটি নির্মিত হয়। ইতিহাসবিদ আহমেদ দানী বাংলাপিডিয়ার এ মতের প্রতি সমর্থন দেন। তবে আরেক ইতিহাসবিদ শরীফউদ্দিনের মতে, এ তথ্যটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, কার্জন হল নির্মাণ করা হয়েছিল ঢাকা কলেজের সম্প্রসারিত ভবন হিসেবে এবং এর জন্য অনুদান প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার। ১৯০৪ সালের ঢাকা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখা যায় যেখানে বলা হয়েছে,
” ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমনে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এ অঞ্চলে লর্ড বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে কার্জন হল নামের একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন”
বাংলাপিডিয়া আরও জানাচ্ছে যে, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে এই ভবন ঢাকা কলেজের একাডেমিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। তারও পরে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শ্রেণীকক্ষ ও পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে যা এখনো এভাবেই চলছে।
কার্জনের রঙ লাল কেন?
কার্জনের রঙ লাল কেন এমন প্রশ্ন শুনতে অবান্তর মনে হলেও লাল কার্জন হওয়ার পেছনে প্রচ্ছন্ন একটি কারণ রয়েছে। এই স্থাপনায় ইউরোপীয় ও মুঘল স্থাপত্যরীতির সম্মীলন ঘটেছে। মুঘল সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির দিওয়ান-ই-খাসের অনুকরণে লাল বেলেপাথরের পরিবর্তে তৈরি এ স্থাপনার মাধ্যমে ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছে উপমহাদেশে তাদের অবস্থান আকবরের মত। কেননা একমাত্র আকবরকেই তারা শ্রেষ্ঠ পরিশীলিত মুঘল শাসক হিসেবে স্বীকার করত।
ভাষা আন্দোলনে কার্জন
ভাষা আন্দোলনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়ে কার্জন হল সাক্ষাত সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা না না বলে প্রতিবাদ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের সাথে এভাবেই জড়িয়ে যায় কার্জন।
স্থাপত্যরীতি
পুরো ঢাকায় কার্জন হলের সমকক্ষ ঐতিহাসিক কোন স্থাপনা খুব সম্ভবত আর নেই। কার্জনই একমাত্র স্থাপনা যা তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো তার রূপরস ধরে রেখে আছে। পাশ্চাত্য ও ইসলামিক স্থাপত্যরীতির সমন্বয়ে গঠিত এ ভবনের উত্তরদিকের সামনের অংশের অশ্বখুরাকৃতি এবং খাঁজকাটা খিলানের অংশ প্রত্যক্ষ করলে বুঝা যায় এখানে কিভাবে ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। কার্জন হলের ভেতরে রয়েছে বিশাল হলরুম যা বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমান অবস্থা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা এ স্থাপত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনার্থীর জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। নিকট-সুদূর থেকে প্রতিদিনই এখানে মানুষ এসে আড্ডা দেয়, জমায়েত হয় নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকা এ ভবনের পাশেই রয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হল ও শহীদুল্লাহ হল; মাঝে এক মনোরম পুকুর স্থাপত্যটিকে দিয়েছে আলাদা আবেদন।