কালাপাহাড়ঃ প্রতিমা ধ্বংস করা ছিল যার নেশা

0

শুনিছ না- ঐ দিকে দিকে কাঁদে রক্ত পিশাচ প্রেতের দল

শবভূক যত নিশাচর করে জগৎ জুড়িয়া কি কোলাহল!

দূর মশালের তপ্ত নিশ্বাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন শিলা!

ধরণীর বুক থরথরি কাঁপে-একি তাণ্ডব নৃত্য লীলা।

এতদিন পরে উঠিল কি আজ সুরাসুর জয়ী যুগাবতার?

মানুষের পাপ করিতে মোচন, দেবতারে হানি ভীম প্রহার, কালাপাহাড়!  

[কালাপাহাড়, মোহিতলাল মজুমদার ]

কালাপাহাড় নামটির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে আমাকে বাংলার ইতিহাস ঘাটতে হবেনা। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান সব সাহিত্যিক মুখরোচক করে কালাপাহাড়কে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করে গেছেন। প্রলয় ও সংহারক মূর্তির বিজ্ঞাপন হিসেবে যে নামটি নির্দেশ করে গেছেন তাঁরা, তিনি কালাপাহাড়।

“কোথা চেংগিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ; ভেংগে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।” [মানুষ, কাজী নজরুল ইসলাম]

“তড়িৎ বাবু কিছু বলার আগেই গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন শোনা গেল, তোমরা রাজুকে দেখেছ! রাজু? দেবতোষবাবু আমাদেরই উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করেছেন। ভদ্রলোক এরই মধ্যে পুব থেকে উত্তরের বারান্দায় চলে এসেছেন। তার লক্ষ্য আমাদের দিকে, তড়িৎ বাবু আমাদের হয়ে জবাব দিলেন, না এরা দেখেনি”  [ রয়েল বেংগল রহস্য, ফেলুদা, সত্যজিত রায়]

সত্যজিত, মোহিতলাল আর নজরুল’দা থাকুক এখানে। আমরা বরং কালাপাহাড়ের জন্মবৃত্তান্ত শুনে আসি।

বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক কট্টর ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজীব লোচন রায় ওরফে রাজু ভাদুড়ী যাকে আমরা কালাপাহাড় জানি। তার বাবা ছিলেন নয়নচাঁদ রায়, যিনি গৌড়ের ফৌজদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। অকালেই নয়নচাঁদ মারা গেলে রাজু মায়ের কাছে লালিতপালিত হতে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাজীব লোচন ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তিনি নিয়মিত বিষ্ণু পূজা দিতেন। রাজীব লোচনের দিনাতিপাতের সমসাময়িক সময়ে দিল্লির মসনদে গদি আঁকড়ে ধরে আছেন নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন আর বাংলায় চলছে হোসেন শাহী বংশের গর্বিত স্বাধীন সুলতানি যুগ। শেরশাহ হুমায়ূনকে সিংহাসনচ্যুত করলে দিল্লি আপাতত মোঘল শাসনের বাইরে চলে যায় এবং শেরশাহের স্বদেশী সেনাপতি সুলায়মান খান কররানী বাংলা অধিকার করেন।

কররানীর খপ্পরে রাজীব লোচন!

সুলায়মান খান কররানী ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন খুবই ধুরন্ধর প্রজাতির। নিজ স্বার্থ আদায়ে কোন কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন ঝানু কূটনীতিক। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, মোঘলদের সাথে তার সহনশীল নীতি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মোঘলদের বিরুদ্ধে তিনি পেরে উঠবেন না। তাই মুঘল সম্রাটদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়মিত উপহার উপঢৌকনাদি পাঠিয়ে শান্ত রাখতেন। উত্তর প্রদেশের শাসক মুনিম খানের মাধ্যমে তিনি সম্রাট আকবরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে  চলতেন আবার তলে তলে “হযরত -ই-আলা” উপাধি ধারণ করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি মূলত একজন স্বাধীন শাসক। সুলায়মানের শাণিত চক্ষুর আড়াল হতে পারেননি কালাপাহাড়। গৌড়ের সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সৈন্য থেকে তুলে আনেন তাকে এবং অসম এক প্রস্তাব দিয়ে বসেন!

কররানীর সুন্দরি কন্যাকে বিয়ে ও গৌড়ের সেনাপতি পদের লোভনীয় প্রস্তাব রাজীব লোচনের সম্মুখে পেশ করেন। স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন রাজীবকে তার দরকার তবে শর্ত আছে ২ টা।

১। তাকে গৃহত্যাগী হতে হবে

২। তাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে

এ প্রস্তাব শুনে আপাতদৃষ্টিতে হতভম্ভ হয়ে যান রাজীব। একদিকে গৌড়ের সেনাপতি আর কররানীর সুন্দরি কন্যাকে পত্নী হিসেবে পাওয়ার দু-দুইটি লোভনীয় প্রস্তাব আর অন্যদিকে নিজের জাতপাত আর ধর্ম বিসর্জন।

অনেক জল্পনাকল্পনা শেষে রাজীব লোচন রায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কররানীর কন্যাকে বিবাহ করে গৌড়ের সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হোন।  ১৫৬৩ থেকে ১৫৭২ এ দশ বছর কররানীর পাশে ছায়ার মত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যান কালাপাহাড়।

মুসলিম মেয়েকে বিবাহ করার অব্যবহিত পর রাজীব লোচন রায় কালাচাঁদ নাম গ্রহণ করেন। যদিও ইতিহাসে তিনি কালাপাহাড় নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, কালাপাহাড় ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর হিন্দু সমাজ তাকে একঘরে করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে কালাপাহাড় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেই মনকষ্টে ভোগেন। তার স্ত্রী সুলায়মান কন্যাও পিতার এহেন দুরভিসন্ধিমূলক কাজ পছন্দ করেননি। শেষপর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শুদ্ধি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে যাবেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে শুদ্ধি অভিযানে অংশ নিতে তার স্ত্রীকে নিয়ে সেথায় গমন করেন এককালের ধর্মপ্রাণ হিন্দু রাজীব লোচন রায়, আশা ছিল তার পুরোহিতরা তাকে আপন করে নিবেন। কিন্তু বিধি বাম! পুরোহিতদের আজ্ঞা- কোন যবন জগন্নাথ মন্দিরের ছায়া মাড়াতে পারবে না। অতীতে যবন কর্তৃক অনেক মন্দির ধ্বংস হয়েছে। লুন্ঠিত হয়েছে সম্পদ। সুতরাং আর কোন সুযোগ দেয়া হবেনা এদের। কালাপাহাড়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা হল, পাহাড়সম অপমানের বোঝা কাঁধে করে ফিরলেন নিজ গৃহে। সেনাপতির পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে। এরপরের অংশ সকলেরই জানা।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির
পুরীর জগন্নাথ মন্দির

আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে সুলায়মান খান কররানী গৌড় থেকে রাজধানী তাণ্ডায় স্থানান্তর করেন। আসাম থেকে উড়িষ্যার প্রতিটি রণাঙ্গনে রাজীব লোচন রায় অসাধারণ সমরকুশীলতার পরিচয় দিয়ে পুরো বাংলায় পরাক্রমশালী সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

প্রতিমা ধ্বংসকারী কালাপাহাড়!

স্বজাতির কাছে বাজেভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা জ্বলছিল কালাপাহাড়ের মনে। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ প্রতিশোধ স্পৃহার বলি হয়েছে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব মন্দির, পিষ্টকরণ করে দেয়া হয়েছে শিল্প, সংস্কৃতির যাগযজ্ঞ। আসাম থেকে উড়িষ্যার খুব কম মন্দিরই রক্ষা পেয়েছে কালাপাহাড়ের গোগ্রাস থেকে। যে মন্দির থেকে তিনি হতোদ্যম হয়ে লজ্জার গ্লানি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন সেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তিনি এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটান। ১৫৬৮ সালে উড়িষ্যা বিজয়ে জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে গরুর চামড়ার ঢোল ও ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরের ভেতরে এক ধরণের অণুরনন সৃষ্টি করেন। এতে উপস্থিত জনতা ভয় পেয়ে যায় এবং প্রতিমা উপড়ে ফেলে পায়ের তলায় পিষ্ট করে কালাপাহাড় তার অপমানের প্রতিশোধ নেন। এছাড়া এ মন্দির থেকে অনেক ধনদৌলত তার হস্তগত হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি কোনাকের সূর্যমন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, ময়ূরভঞ্জের মন্দির ও মেদিনীপুর মন্দির। সুভদ্রা ও জগন্নাথ মন্দিরের কাঠের প্রতিমা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠে কালাপাহাড়ের উপর। প্রতিমা ধ্বংসের চেয়ে ধনসম্পদ লুটপাটেই তিনি আগ্রহী ছিলেন বেশি।

কোণাক সূর্যমন্দির
কোণাক সূর্যমন্দির , Photo

প্রতিরোধের মুখে কালাপাহাড়!

সম্বলপুরের মা সম্বলশেরীর প্রতিমা ধ্বংস করতে এলে সেখানকার সনাতন ধরমালম্বি কর্তৃক প্রতিরোধের মুখে পড়েন কালাপাহাড়। সম্বলপুরের মন্দির রক্ষার্থীরা কালাপাহাড়কে দমাতে এক অভিনব কায়দা গ্রহণ করে। কালাপাহাড়ের সেনা ক্যাম্পে গোয়ালিনীর বেশ ধরে এক মহিলা সৈন্যদের নিকট বিষমিশ্রিত দুধ, দই, ছানা ইত্যাদি বিক্রি করলে তা খেয়ে কালাপাহাড়ের বেশিরভাগ সৈন্য বিষক্রিয়ায় মারা যান। উপায়ন্তর না দেখে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে পালিয়ে কোনরকম প্রাণ বাঁচিয়ে এ যাত্রা রক্ষা পান।

কালাপাহাড়ের প্রয়াণ

সুলায়মান খান কররানী তার জীবদ্দশায় উত্তর প্রদেশের শাসক মুনিম খানের মাধ্যমে মুঘলদের সাথে আতিথ্য বজায় রেখে চলতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ পুত্র দাঊদ খান উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেন। তিনি নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে প্রকাশ্যে মুঘলদের বিরোধিতা শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে সম্রাট আকবর মুনিম খানকে তাণ্ডা দখলের জন্য প্রেরণ করেন। মুনিম খান বীরত্বের সাথে তাণ্ডা দখল করে দাঊদ খানকে বিতাড়িত করেন। দাঊদ পালিয়ে যান উড়িষ্যায়। দাঊদের সাথে ছায়ার মত লেগে ছিলেন কালাপাহাড়। এদিকে তাণ্ডায় প্লেগের আক্রমণে স্বয়ং মুনিম খান সহ মুঘল অনেক সৈন্য মারা যায়। আর এ সুযোগে আবার তাণ্ডা দখল করে নেন দাঊদ খান। সাথে ছিলেন চেনামুখ, কালাপাহাড়। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই দাঊদ খানকে পরাজিত করতে দিল্লী থেকে এক বিশাল বাহিনী প্রেরিত হয় রাজা টোডরমল ও খানজাহান হোসেন কুলির নেতৃত্বে। বীরবিক্রমে লড়াই করে কামানের একটি গোলার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন বীর কালাপাহাড়।

উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদী নদীর তীরে কালাপাহাড়ের সমাধি ২০০৬ সালে উগ্র হিন্দুদের রোষানলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

স্মরণে কালাপাহাড়

কালাপাহাড়ের জীবদ্দশায়ই তিনি এতটা জনপ্রিয়  হয়ে গিয়েছিলেন যে, মন্দির, শহর, কামানের নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছিল তার নামে যা আজও দৃশ্যমান। যে আসামের কামাখ্যা মন্দিরে তিনি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন সে আসামেই তার নামে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে, মণিপুরে সৃষ্টি হয়েছে কালাপাহাড় সিটি। মহারাষ্ট্র প্রদেশের দৌলতবাদের একটি কামানের নাম দেয়া হয়েছে কালাপাহাড়, বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার একটি উপজেলায় রয়েছে কালাপাহাড় মসজিদ। বাগেরহাটের প্রখ্যাত সুফিসাধক খানজাহান আলীর দুটি কুমির ছিল কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামে।

তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্যক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কালাপাহাড়কে জীবন্ত করে রেখেছেন তাঁদের লেখার মাধ্যমে।

 

 

তথ্যসূত্র : আমার নাম কালাপাহাড়, বিশ্বনাথ ঘোষ

উইকিপিডিয়া

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More