প্রাচীন বৈদিক যুগে বিবাহের রীতিনীতি

0

আদিম সমাজেও সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো মানুষ। তবে এখনকার মতো করে নিশ্চয়ই নয়। তখন পশু শিকারের জন্য মানুষ গুহায় বাস করতো। যখন মানুষ একেকটি শ্রেণি তথা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেল, তখনই জন্ম নেয় পরিবার প্রথা। তখন থেকেই নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরকে একই গুহায় আলিঙ্গন করতে থাকে। এভাবে যখন বরফ যুগের সমাপ্তি ঘটলো, তখন মানুষ বের হয়ে এলো গুহা থেকে। গাছের ছাল দিয়ে তৈরি বস্ত্র পরিধান করতো অথবা বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়াত। ধীরে ধীরে মানুষ প্রস্তর নির্মিত অস্ত্র ও আগুন ব্যবহার শিখে গেল। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানো তখন মানুষের কাছে এক মিনিটের কাজ। কিন্তু তখনও মানুষ ঘড়ি দেখা শেখেনি। সূর্যের উদয়াস্ত দেখেই সময় নির্ণয় করতো আদির লোকজন।

পরবর্তীতে যখন নিয়নডার্থাল মানুষের আবির্ভাব হলো্, তখন তাদের মধ্য থেকেই সমাজের নেতা নির্বাচন করা হলো। তারাই সমাজের ন্যায়ান্যায় নির্ধারণ করে দিতেন ও বিধিভঙ্গ হলে কঠোর শাস্তি দিতেন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন পুরুষ। সুতরাং তখন থেকেই যা কিছু ভালো তার সবটুকুই বেছে নিলো পুরুষ আর নারীর পাতে রাখা হলো এঁটো ভাতের অংশবিশেষ। সম্ভবত এ সময় থেকেই নীতিশাস্ত্রের চর্চা শুরু হয় ও বিভিন্ন ধর্মও প্রচার করা হয়। এসব ধর্মগ্রন্থে নারী-পুরুষ একত্রে থাকার বিধানকে সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে বলা হতে থাকে। প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন কিংবা ভারতবর্ষে স্বাভাবিকভাবেই দাসদাসী বেচাকেনা হতো। এসব দাসদাসী কিনে তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হতো। কিন্তু তখনকার সমাজ এসবের বৈধতা দিয়েছিল। ফলে সমাজের প্রায় সবাই খোলাখুলিভাবেই এই ধরনের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করতো।

প্রাচীন রোমেও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন করা হতো। এসব সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এক রাজার সঙ্গে আরেক রাজার বিরোধ চরম রূপ নিতো। অনেক সময় সেটা যুদ্ধে রূপ নিতো। ঠিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই ট্রয় নগরীর রাজা হেলেনের রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেছিল। কারণ সেই রাজ্যে মদ্যপান, সমকামিতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক প্রভৃতি বৈধ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল যা স্বাভাবিকভাবেই কোথাও বৈধ বলে বিবেচিত হয় না।

ভারতবর্ষে যখন আর্যরা এসেছিল তখন এদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ ও নির্ভেজাল জীবনযাপন করতো। তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল না। এদেশের মানুষ তখন মাছ শিকার করতো, নৌকা চালাতো। আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আসে, তখন থেকেই ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ শুরু হয়। আর্যরাই বেদ গ্রন্থের বিধান এদেশে চালু করেছে। তারাই এদেশের মানুষের মধ্যে বেদ গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে। তবে আর্যরা এদেশে খুব কমসংখ্যক নারী নিয়ে এসেছিল। ফলে তারা যেহেতু এদেশের নারীদের বিবাহ করতো না, সেহেতু তারা নিজেদের মধ্যে একটা নিয়ম করল সেটি হলো বড় ভাইয়ের বউ মানে হলো সেই বউ অন্য ভাইদেরও বউ। অন্য ভাইরাও সেই বউয়ের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করতে পারতো। বড় ভাই যদি মারা যান তবে সেই ভাইয়ের পরে যে ভাই থাকবে, তার অভিভাবকত্বে থাকবে বড় ভাইয়ের সেই বউ। পরে অবশ্য আর্যরা এদেশের নারীদের বিবাহ করতে বাধ্য হয়েছিল।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য, বৈদিক যুগে নারীদের স্বাধীনতা ছিল। তারা স্বেচ্ছায় পতি নির্বাচন করতে পারতো। এটা ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে (৭/২/৫) বর্ণিত আছে। সায়ন একে উল্লেখ করেছেন ‘সমন’ উৎসব হিসেবে। এই উৎসবে শাস্ত্রজীবী, সুদক্ষ অশ্বারোহী, ক্রীড়াবিদ, রথী, নট ও কবিরা নিজ নিজ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পুরস্কার লাভ করতেন। এই উৎসবে নারীরা স্ফূর্তি করতো ও মনমতো পতিলাভের আশায় সুসজ্জিতা হয়ে যেতেন। এছাড়া বারাঙ্গনারাও ধনসম্পদ লাভের আশায় সেখানে উপস্থিত থাকত। সারারাত ‘সমন’ উৎসব চলত। অথর্ববেদে একথাও বলা হয়েছে যে ‘সমন’ উৎসবে গৃহীত হওয়া অনূঢ়া মেয়েদের একটা বাঞ্ছনীয় গুণ বলে বিবেচিত হত। তবে ঋগ্বেদের যুগে মেয়েরা অনূঢ়াও থেকে যেত। এই ধরনের মেয়েদের বলা হত ‘পুত্রিকা’। আর সেটি না হলে অবিবাহিত মেয়েদের ‘কন্যা’ বা ‘দুহিতা’ বলেই ডাকা হত। বিবাহিত মেয়েদের বলা হতো ‘জায়া’, ‘জনি’ ও ‘পত্নী’। যুগ্মভাবে স্বামী-স্ত্রীকে বলা হতো ‘মিথুন’ বা ‘দম্পতি’। অনূঢ়া মেয়েদের প্রেমিককে বলা হত ‘জার’, আর যদি সে অবিবাহিতা অবস্থায় পিতৃগৃহেই থেকে যেত তাহলে তাকে বলা হতো ‘আমাজুর’।

তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দাবি করে থাকে যে তাদের মধ্যে প্রচলিত বিবাহের রীতিনীতি সেই বৈদিক যুগ থেইে অনুসৃত হয়ে আসছে- একথাটি ঠিক নয়। গোত্র-প্রবর সপিণ্ডবর্জনবিধি যার ওপর হিন্দুদের বিবাহপ্রথা প্রতিষ্ঠিত, তার উল্লেখ বৈদিক যুগের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে মোটেও নেই। তাছাড়া, ঋগ্বেদের যুগে গ্রামভিত্তিক বহির্বিবাহের ওপর বিবাহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। কারণ, ঋগ্বেদের বিবাহ সম্পর্কিত স্তোত্র থেকেই বোঝা যায়, পাত্রপাত্রী বিভিন্ন গ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতো ও ‘দিধিষু’ নামে এক শ্রেণির মধ্যগের মাধ্যমেই বিবাহের যোগাযোগ সাধিত হয়। নবপরিণীতা যে অন্য গ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকত তা তার ‘বধূ’ আখ্যা থেকে বোঝা যায়। কারণ ‘বধূ’ অর্থ হলো ‘বহন করে আনা হয়েছে যাকে’। বৈদিক যুগের বিবাহ সম্পর্কে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, নবপরিণীতার বিবাহ কোনো বিশেষ শ্রেণির সঙ্গে হতো না। তার আপন সহোদর ভাইয়ের সঙ্গেই বিবাহ হত। আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রের যুগ পর্যন্ত এই রীতি প্রচলিত ছিল। কেননা, আপস্তম্ভ সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, কন্যা দান করা হয় কোনো নির্দিষ্ট সহোদরকে নয়, বংশের সব ভ্রাতাকে। এজন্য পরবর্তীকালে মনু বিধান দিয়েছিলেন, কলি যুগে কন্যার বিবাহ যেন পুরো পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে না দেওয়া হয়। মনুর এমন বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে কলি যুগের আগে কন্যার বিবাহ সমগ্র পরিবারের সঙ্গেই দেওয়া হতো। ঋগ্বেদে ও অথর্ব বেদে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যদিও বধূকে জ্যেষ্ঠভ্রাতাই বিবাহ করতো, তারপরও অন্যান্য ভ্রাতারও সেই বধূকে রমণের তথা যৌন মিলনের অধিকার থাকতো। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ‘দেবৃ’ বা ‘দেবর’ বলা হয়েছে। কেননা ‘দেবর’ হলো ‘দ্বি-বর’ তথা ‘দ্বিতীয় বর’।

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক স্তোত্র থেকে বোঝা যায়, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী দেবরের সাথেই স্ত্রীরূপে বসবাস করত। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি উঠে পড়, যে দেবৃ তোমার হাত ধরেছে তুমি তারই স্ত্রী হয়ে তার সঙ্গে বসবাস করো।’ অথর্ববেদের এক স্তোত্রে (১০/৩/১-২) অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র:
১. ভারতে বিবাহের ইতিহাস, অতুল সুর;
২. বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, অতুল সুর;
৩. ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়নডার্থাল থেকে নাস্তিক), ভবানীপ্রসাদ সাহু;
৪. পৃষ্ঠা ৯-১১, বেদ ও বৈদিক সাহিত্য: নারী, সুষ্মিতা কর, বৃন্ত (দ্বিতীয় সংখ্যা)।

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More