গণহত্যা শব্দের ইংরেজি পারিভাষিক শব্দ Genocide। এর আরও কয়েক সমার্থক শব্দ হলো Racial Kiliing, Massacre ও indiscriminate killing। সাধারণত গণহত্যা বলতে আমরা Genocide-কেই বুঝে থাকি। গ্রিক শব্দ Genos ও ল্যাটিন শব্দ Cide- দুই ভাষার শব্দ একত্রিত করলে দাঁড়ায় Genocide। Genos শব্দের অর্থ ‘নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতি’ আর Cide শব্দের অর্থ ‘হত্যা’।
১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘Axis Rule in Occupied Europe: Laws of Occupation- Analysis of Government- Proposals for Redress’ নামক গ্রন্থে গণহত্যা শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করা হয়। আইনি পরিমণ্ডলে শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করা হয় ১৯৪৫ সালে। ন্যুরেমবার্গে গঠিত আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে নাৎসি নেতাদের বিচারে গণহত্যা শব্দের প্রয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘে গণহত্যা নিষিদ্ধ করে একটি রেজ্যুলেশন পাস করেন রাফায়েল লেমকিন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কনভেনশনে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেব স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এখন আমরা জানবো বিংশ ও একবিংশ শতকের গণহত্যার ইতিহাস। চলুন জেনে আসা যাক-
গ্রিক গণহত্যা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়কালে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯১৩-১৯২৩’র মধ্যে গ্রিসে ঘটে যাওয়া এই গণহত্যা ইতিহাসে গ্রিক গণহত্যা হিসেবে সমালোচিত হয়ে আসছে। পন্টাস, ক্যাপাডোসিয়া, আইওনিয়া ও ইস্টার্ন থ্রেসকে লক্ষ্য করে এই গণহত্যা পরিচালনা করে গ্রিকো-তুর্কি সেনাবাহিনী। এই গণহত্যা চলাকালেই শুরু হয় তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালে উসমানীয় অধীনতা থেকে তুর্কিরা মুক্তি লাভ করে এবং ১৯২৪ সালে সাংবিধানিক চুক্তির মধ্য দিয়ে উসমানীয় খেলাফত বিলুপ্ত করা হয়। গ্রিক গণহত্যায় ৩-৯ লাখ বেসামরিক লোকের প্রাণহানি হয়।
আর্মেনীয় গণহত্যা
আর্মেনীয় গণহত্যা শুরু হয় ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল। শেষ হয় ১৯২৩ সালে। এই গণহত্যা চালায় অটোমান সাম্রাজ্য। এতে ৬ লাখ থেকে ১৫ লাখ লোক নিহত হয়।
দ্য হলোকস্ট
দ্য হলোকস্ট ইউরোপে ইহুদি গণহত্যা নামেও সমধিক পরিচিত। হলোকস্টকে হিব্রু ভাষায় ইহুদিরা হাশোয়া বলে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদিদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তাকে দ্য হলোকস্ট বলা হয়। নাৎসিবাদী জার্মান ও তাদের মিত্ররা ৬-১১ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে।
‘৭১’র গণহত্যা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তা ‘৭১’র গণহত্যা হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, শেখ মুজিবের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও পশ্চিম পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সার কারণে গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা এই গণহত্যায় ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়।
কম্বোডীয় গণহত্যা
১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল কম্বোডীয় গণহত্যার শুরু। ১৯৭৯ সালের ৭ জানুয়ারি এটি শেষ হয়। গণহত্যা শুরু করে খেমার রুজ। ১৯৭৫-১৯৭৯ সময়কালে কম্বোডিয়ার শাসকগোষ্ঠী এই নামে পরিচিত। তারা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অব কাম্পুচিয়ার (সিপিকে) সদস্য। এই গণহত্যায় ১২-২৮ লাখ লোক প্রাণ হারায়।
রুয়ান্ডা গণহত্যা
রুয়ান্ডার সংখ্যালঘু টাটসি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল নির্বিচারে যে গণহত্যা শুরু হয়, তাই ইতিহাসে রুয়ান্ডা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। একই বছর ১৯ জুলাই শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের এক চুক্তির মধ্য দিয়ে এই গণহত্যার সমাপ্তি হয়। রুয়ান্ডা গণহত্যায় ৮-১০ লাখ লোক নিহত হয়।
বসনীয় গণহত্যা
১৯৯৫ সালে ১১-১৩ জুলাই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় যে গণহত্যা চলে, বিশ্ব ইতিহাসে সেটা বসনীয় গণহত্যা হিসেবে তুমুল সমালোচিত হয়ে রয়েছে। এতে শুধু স্রেব্রিনিকা শহরেই ৮ হাজার ৩৭১ জন প্রাণ হারায়। এ ছাড়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা জুড়ে চালানো এই গণহত্যায় ২৫ হাজার ৬০৯ থেকে ৩৩ হাজার ৭১ জন নিহত হয়।
রোহিঙ্গা গণহত্যা
মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠীর ভয়াবহ নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২০১৭ সালে জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান থেকে রেহাই পেতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বড় আকারের ঢল দেখা যায়। সংবাদপত্রের খবরাখবর অনুযায়ী মিয়ানমারের জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই গণহত্যায় ২৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়।
গাজা গণহত্যা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর থেকে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, চলমান এই গণহত্যায় (এই কনটেন্ট লেখা পর্যন্ত) ৪০ হাজার ৮৭৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.