মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় প্রথম চন্দ্রগুপ্তকে। গ্রিকরা তাকে ‘কোট্টাস’ নামে ডাকতেন। যার বাংলা অর্থ মুক্তিদাতা। অর্থাৎ প্রাচীন গ্রিসের বাসিন্দারা একজন পরিত্রায়কের খোঁজে পথ চেয়ে ছিলেন। যিনি এসে তাদের মুক্তি দেবেন, স্বপ্ন দেখাবেন নতুন করে পথচলার। শোনা যায়, প্রাচীন গ্রিসের একটি অংশও তার দখলে ছিল। মৌর্য বংশের প্রথম নৃপতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ্যসীমা উত্তর-পশ্চিমে পারস্য, পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্বে বাংলা এবং দক্ষিণে মহীশূর ও মাদ্রাজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অখণ্ড ভারতবর্ষ স্থাপনের ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন এই চন্দ্রগুপ্ত। তিনি ভারতের সীমানাকে একেবারে আরব পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। এমনকি আলেকজান্ডারের সঙ্গেও তার যুদ্ধ হয়েছিল। গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস নিকটোরকে পরাজিত করেন এবং সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বালুচিস্তান ছেড়ে দেন। সেই সঙ্গে সেলুকাস তার নিজ কন্যা হেলেনের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করান এবং মেগাস্থিনিসকে নিজের দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে ভারত সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও উপলব্ধি তুলে ধরেছেন।
চন্দ্রগুপ্তের পরে: শেষজীবনে পুত্র বিন্দুসারকে রাজত্বভার অর্পণ করে জৈনধর্ম গ্রহণ করেন চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮-২৭৩ অব্দ)। এরপর জৈনপণ্ডিত ভদ্রবাহুর সঙ্গে মহীশূরের শ্রাবণগোলায় যান এবং সেখানে ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অনশনে দেহত্যাগ করেন (জৈনশাস্ত্র পরিশিষ্টপার্বণ)। চন্দ্রগুপ্তের প্রয়াণের পর উত্তরাধিকারী হিসেবে নৃপতি হিসেবে রাজত্ব করেন বিন্দুসার।
চন্দ্রগুপ্তের পুত্র বিন্দুসারের (খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮-২৭৩ অব্দ) আরেকটা নাম ছিল। আর তা হলো ‘অমিত্রঘাত’ বা শত্রুহননকারী। তার রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত বিস্তৃতি হয়েছিল। তিনি ছিলেন আজীবিক ধর্মের অনুসারী। পিঙ্গল বৎস নামে এক আজীবিক ভবিষ্যদ্বক্তা বা জ্যোতিষী তার রাজদরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন।
নৃপতি বিন্দুসারের রাজত্বকালেই গ্রিক নাবিক পেট্রোক্লেস ভারত মহাসাগরে অভিযান করে বহু তথ্য সংগ্রহ করেন। তার রাজত্ব বিস্তার নিয়ে ঐতিহাসিকরা বলেছেন, বিন্দুসার আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যভূমি দখলে নিয়েছিলেন।
কলিঙ্গের যুদ্ধ: পিতা বিন্দুসারের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের পরবর্তী নৃপতি হন সম্রাট আশোক। পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের জন্য তিনি ভ্রাতৃ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে, কলিঙ্গের যুদ্ধে তিনি তার ৯৯ ভাইকেই হত্যা করেছিলেন। শুধু ছোটভাই তিসসাকে রেহাই দেন। ‘দিব্যবদন’ ও ‘সিংহলী’ নামে প্রাচীন যুগের উপাখ্যানে তার এই ভ্রাতৃ যুদ্ধের বিষয়ে বর্ণনা আছে।
প্রথম জীবনে সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দ) ছিলেন উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা। পরে তক্ষশীলায় প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি তার যোগ্যতা প্রমাণ করেন। অশোকের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম ঘটনা হলো কলিঙ্গের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ২৬০ বা ২৬১ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে হয়েছিল। কলিঙ্গের যুদ্ধে তারই জয় হয় এবং কলিঙ্গের রাজধানী হয় তেসালি। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সম্রাট অশোকের মনে অনুতাপ জন্মে। বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন তিনি। এই সময়েই বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন সম্রাট অশোক। চণ্ডাশোক যেন ধর্মশোকে পরিণত হয়ে যায়। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে সিংহলে পাঠান অশোক। তার রাজত্বকালেই ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই সংগীতির পর বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে নির্বাচিত করে বিভিন্ন স্থানে পাঠান তিনি। তার অভিপ্রায় ছিল বৌদ্ধধর্ম প্রচার। ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক প্রয়াত হন।
তথ্যসূত্র:
১. ইরফান হাবিব ও বিবেকানন্দ ঝা, ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস-৪: মৌর্যযুগের ভারতবর্ষ;
২. বায়োগ্রাফি, থট কো;
৩. শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম ইনস্টিটিউট (হাই স্কুল)।
[…] অশোক-কথা, মৌর্য-কথা […]