সিরিয়ায় গুপ্তচরবৃত্তির জন্য পরিচিত এলি কোহেন। ১৯৬১-১৯৬৫ সালের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে হয়েছিলেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা।
১৯৬৫ সালে সিরিয়ার কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং একই বছর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ধারণা করা হয়, গ্রেপ্তারের আগে কোহেনের সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যগুলো ইসরায়েলকে ছয়দিনের যুদ্ধে সাফল্য এনে দেয়।
১৯২৪ সাল। এই বছরেই উসমানীয় খেলাফতকে চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত করা হয়। যাত্রা শুরু করে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। ঠিক এই বছরেই মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় এক ধর্মপ্রাণ জায়নবাদী ইহুদি পরিবারে জন্ম এলি কোহেনের।
এলি কোহেনের বাবা সিরিয়ার আলেপ্পো শহর ছেড়ে মিশরে এসেছিলেন। ১৯৪৭ সালের দিকে মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন তিনি। তবে আনুগত্যের প্রশ্নে সন্দেহভাজন হওয়ায় দ্রুতই তাকে বাদ দেওয়া হয়।
ইহুদি হওয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা তাকে হয়রানি করতে থাকে। এ-সমস্যার সমাধান হিসেবে ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ঘরে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত নেন কোহেন।
১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, তখন মিশরের অনেক পরিবার ইসরায়েলে স্থানান্তর হতে শুরু করে। তার পরিবার মিশর ত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে।
পরিবার ইসরায়েলে স্থানান্তর হলেও এলি কোহেন তখনও মিশরে রয়ে যান। ইলেক্ট্রনিক্সের ওপর পড়াশুনা শেষ না হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে মিশরের ইহুদিদের সহায়তা ও জায়নবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকলেন তিনি।
এর মধ্যেই মিশরে রাজা ফারুকের রাজত্ব খর্ব করতে অভ্যুত্থান শুরু করেন মোহাম্মদ নাগুইব ও জামাল আবদেল নাসের। ১৯৫২ সালে তাদের সেই অভ্যুত্থানে এলি কোহেন গ্রেপ্তার হন। জিজ্ঞাসাবাদে ইসরায়েলে অত্যাচারিত মিশরীয় সংখ্যালঘু ইহুদিদের ইসরায়েলে পাঠানোর ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
দোষী সাব্যস্ত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হয়নি।
সন্দেহ হয়, ১৯৫৪ সালে আত্মঘাতী সুসান অভিযানেও কোহেন জড়িত থাকতে পারেন। যার লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে মিশরকে বেকায়দায় ফেলা। তবে এবারও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি মিশরীয় কর্তৃপক্ষ।
১৯৫৬ সুয়েজ খাল খননকে কেন্দ্র করে সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ে মিশর। এ সময় দেশটির সরকার সংখ্যালঘু ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক ইহুদির নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদের তাড়িয়ে দেয়।
তখন একটি ইহুদি সংস্থার মাধ্যমে ইতালির নেপলস শহর দিয়ে হাইফা বন্দরে এসে পৌঁছান কোহেন।
১৯৫৭ সালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগদান করেন এবং দেশটির সামরিক গোয়েন্দা শাখায় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু খুব দ্রুতই এই কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং মোসাদে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকেন।
মোসাদে ঢোকার চেষ্টা করেও বিফল হন। রেগেমেগে সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস পদ থেকে ইস্তফা দেন।
পরের দুই বছর তেল আবিবের একটি বিমা সংস্থায় কোহেন কেরানী হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৫৯ সালে কোহেন উদারপন্থী লেখক সামি মাইকেলের বোন ইরাকি-ইহুদি নারী নাদিয়া মাজাল্ডকে বিয়ে করেন। সোফি, ইরিত ও শাই নামে তাদের ৩ সন্তান আছে। বিয়ের পর তেল আবিব শহরের দক্ষিণে বাতইয়ামে বসবাস করতে থাকেন তারা।
আগেই বলেছি, মোসাদের চাকরিতে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তদানীন্তন মোসাদ প্রধান মেইর অমিত তাকে ডেকে নেন এবং ট্রেনিং করার নির্দেশ দেন।
ট্রেনিং শেষে তাকে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে গুপ্তচর হওয়ার জন্য সম্পূর্ণভাবে উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়।
একাধিক মিশন পরিচালনার পর মোসাদের এজেন্ট কোহেনের প্রকৃত পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। সিরিয়ায় নতুন নিযুক্ত হন গোয়েন্দা উপদেষ্টা কর্নেল আহমেদ সু’এদানি। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে সিরিয়া কর্তৃপক্ষ গোয়েন্দা তথ্য চুরি উদ্ঘাটন শুরু করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে এনে বিভিন্ন শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে অন্য দেশে পাঠানো কিছু রেডিও সংকেত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সিরিয়া কর্তৃপক্ষ। এসব রেডিও সংকেতের উৎস তারা বের করে।
২৪ জানুয়ারি সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কোহেনের বাসায় ঢুকে রেডিও সংকেত পাঠানো অবস্থায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এরপর ১৯৬৫ সালের ১৮ মে প্রকাশ্যে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুর তিনদিন আগে স্ত্রীর উদ্দেশে সবশেষ চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় নাদিয়া, তোমার প্রতি আমার অনুরোধ, যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে শোক কোরো না। তুমি বরং নিজের খেয়াল রেখো ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য আশা রেখো।’
http://www.longisland.com
মোসাদ এজেন্ট কোহেন-কথা – ইতিবৃত্ত