ফজলুর রহমান খান-কে টিউব ডিজাইনের জনক অভিধায় অভিহিত করা হয়। বর্তমান আর্কিটেক্টদের রাত-দিনের সঙ্গী computer-aided design (CAD) এর অন্যতম পাঞ্জেরী হিসেবেও তার অবদান কম নয়।

ফজলুর রহমান খান এমন এক সময়ে বিশ্বের ভবন নকশার জগতে প্রবেশ করেন যখন এই জগতে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রধান প্রতীক আকাশচুম্বী অট্টালিকা যা জানান দিবে সেই জাতির ধনতান্ত্রিক অগ্রগতি। শুধু প্রতীকই নয় বিশ্বের ক্রম বর্ধমান অর্থনৈতিক চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানর জন্য Skyscraper গুলোর জন্ম নয়। বরং বেড়ে চলা অফিসের জায়গা সংকুলান হওয়ার জন্য এই অট্টালিকাগুলার ব্যাপক আগমন ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু তখনকার
প্রকৌশলবিদ্যার এতো অগ্রগতি হয়নি। উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণে উচ্চ নির্মাণ খরচ, স্থায়িত্বের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে এক হ-য- ব-র- ল অবস্থা।
ঠিক এই সময় ত্রাণকর্তা হিসেবে বাঙালি রাজপুত্র Einstein of structural engineering, Greatest Structural Engineer of the 20th Century দেখা দেন তার টিউব Structure নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে।
আকাশচুম্বী Skyscraper আর যাই হোক তার নির্মাণ খরচ কখনই কমাতে পারেনি । একটা ঢেঙ্গা লম্বা দালান যার ভিতরে শুধু টাকাওয়ালা মানুষেরই যাতায়াতের সুবিধা আছে। শুধু টাকাওয়ালা মানুষেরই সেই দালানে অফিস করবার সুযোগ আছে। সাধারণ আমেরিকানদের মনে এই খুঁতখুঁতানিই বেশী ছিল যতদিন না Skyscraper গুলো প্রতিটি আমেরিকান শহরের আকাশ ফুরে উঠতে শুরু করল। কিন্তু যত Skyscraper-ই হোকনা কেন তার খরচ, উচ্চতা আর স্থায়িত্ব ভবন নির্মাতাদের ভাবিয়ে তুলতে থাকে ধীরে ধীরে।

ফজলুর রহমান খান ১৯২৯ সালের ৩রা এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলার ফরিদপুরের ভাণ্ডারী-কান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুর রাহমান ছিলেন হাই স্কুলের গণিত শিক্ষক আর পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা। আব্দুর রাহমান পদোন্নতির ধারায় বাঙাল অঞ্চলের Public Instructions-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। আর অবসরের পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পুত্র ফজলুর রাহমান খান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেন। উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন তৎকালীন ভারতের শিবপুরের Bengal Engineering and Science University-তে Civil Engineering-এ।
কিন্তু এর পর তিনি আবার ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) এ ভর্তি হন আর তার সম্মান শ্রেণির পড়াশুনা শেষ করেন। এরপর আমেরিকান Fulbright Scholarship আর Pakistan সরকারি বৃত্তি জিতে নেন এই স্থপতি। এই বৃত্তিগুলো তার আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করে দেয়। ১৯৫২ সালে তিনি ভর্তি হন University of Illinois-এ, মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি অর্জন করে নেন দুইটি মাস্টার্স ডিগ্রি আর একটা পিএইচডি ডিগ্রি। মাস্টার্স গুলো Structural Engineering আর Theoretical and Applied Mechanics এবং পিএইচডি Structural Engineering এর উপর। তার উদ্ভাবনের মাঝে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তার Tube Principle-টি। এছাড়াও ছিল Tube in Tube, Bundle Tube, Outrigger and Belt Truss, Concrete Tube Structures, Shear Wall Frame Interaction System সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। সাধারণ অট্টালিকা আর আগের আকাশচুম্বী অট্টালিকা গুলির মূল কাঠামো ছিল সনাতনী ধাঁচের। ভবনের মাঝ বরাবর চাপ বেশী হওয়ায় আর উঁচু ভবনগুলোর ইস্পাত নির্ভর কাঠামোর জন্য সেগুলোর দীর্ঘ স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা যেমন ছিল না তেমনি ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে ঠিকে থাকার ক্ষমতা ছিল নগণ্য। কিন্তু তার প্রবর্তিত টিউব Structure ছিল এই কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফজলুর রাহমান খান তার এই পদ্ধতিতে ভবনের মাঝের পরিবর্তে সাপোর্ট Structure হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন ভবনের বাহিরের আস্তরণকে। সাধারণ টিউব এর মতই মাঝ বরাবর ভার কেন্দ্রের শক্তিতে নয় বরং ভবনের চতুর্দিকের শক্তিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে শিখে গেল উচ্চ অট্টালিকাগুলো। ফলে ভবন নির্মাণে ইস্পাতের ব্যবহার নাটকীয় ভাবে কমে গেল। অট্টালিকার ভার সমভাবে বন্টিত হওয়ায় ভবনগুলোর উচ্চতা বাড়ানো সম্ভব হল প্রয়োজন মতো।

অট্টালিকাগুলো মুক্তি পেলো আগের বাক্স আকৃতির রূপ থেকে। আর শেষ কথা হলেও কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় স্থাপত্যগুলোর ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহন করার ক্ষমতা বেড়ে গেল বহুগুণ। স্থাপত্য নির্মাণে আজ পর্যন্ত প্রতিটি উচ্চ অট্টালিকায় এই টিউব Structure ব্যবহার হচ্ছে।

শিকাগোর বিখ্যাত স্থাপত্য ডিজাইনিং ফার্ম Skidmore, Owings and Merrill সংক্ষেপে SMO। ১৯৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান ফজলুর রাহমানের সৃজনশীলতার পূর্ণ বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। তিনি খুব সহজে এবং দ্রুততার সাথে তার সমসাময়িক স্থপতিদের থেকে নিজেকে আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে সামর্থ্য লাভ করেন। তিনি নিজেকে প্রথম প্রমাণিত করতে সুযোগ পান ১৯৬৪ সালে ৪৩ তলা Chestnut De-Witt apartment building নির্মাণের সময়। আর ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করেন ৩৫ তলা Brunswick Building। এই ভবনগুলি হয়তো তার সেরা কাজগুলোর একটি না কিন্তু ভবিষ্যতের একজন মেধাবী স্থপতির সকল গুণাবলি প্রকাশ পেতে থাকে তার মাঝে। তার মেধার প্রমাণ পেয়ে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি স্থপতি হিসেবে যোগ দান করেন তারাই ১৯৬৬ সালে তাকে সেই ফার্মেরই একজন ব্যবসায়িক পার্টনার করে। এর একবছর পরই তাঁকে আমেরিকার নাগরিকত্ব দেয়া হয়। ১৯৬৭ সালেই সাফল্য তাকে নিয়ে আসে ১০০ তলা John Hancock Center নির্মাণে।

১৯৩১ সালে Empire estate building সারা বিশ্বের বুকে সর্বোচ্চ ভবনের খেতাবটুকু ছিনিয়ে নেয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই দালানটিই হয়ে ওঠে আমেরিকার অগ্রগতির প্রামাণ্য প্রতীক। সবার আশা ছিল এই ৩৮১ মিটারের ভবনটিই যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবনের খেতাবটুকু আঁকড়ে ধরে থাকবে। John Hancock Center যখন নির্মাণ করা হয় তখন এটি হয়ে যায় ১০০ তলার আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন। কিন্তু World Trade Center ১৯৭২সালে নির্মাণের ফলে Empire State Building চলে যায় দ্বিতীয় স্থানে। আর ফজলুর রাহমানের কীর্তি ৩য় স্থানে। মজার ব্যাপার হল World Trade Centre এর স্থপতি না হলেও এই ভবনেও প্রয়োগ করা হয়েছিল টিউব Structure পদ্ধতিটি। কিন্তু দুই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফজলুর রাহমান খানের নকশায় নির্মিত হয় Willis Tower (তৎকালীন সিয়ারস Tower)। ১৪৫১ ফুটের এই দানব আজো আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন আর সারা বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ ভবন। এই টিউব Structure-এর বেশ কিছু আলাদা আলাদা সংস্করণ তৈরি করেছিলেন ফজলুর রাহমান খান। “Framed Tube,” “Trussed Tube,” “Bundled Tube”. শুধু তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি। ভবন নির্মাণে প্রয়োগ করে যে সাফল্য দেখিয়েছেন তা আজ সারা বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। তার প্রথম মাস্টারপিস John Hancock Center এ তিনি Trussed-tube পদ্ধতি আর X-bracing ব্যবহার করে তাকে করে তোলেন সাশ্রয়ী আর দীর্ঘস্থায়ী। যেখানে Empire State Building নির্মাণে প্রতি বর্গ মিটারে ২০৬ কেজি ইস্পাত ব্যবহার করা হয় সেখানে John Hancock Center এ ব্যবহৃত হয় ১৪৫ কেজি করে ইস্পাত।
এরই মাঝে শুরু হয় বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধ। প্রবাসে থাকা ফজলুর রাহমান খান দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও বিদেশের মাটিতে মাতৃভূমির সংগ্রাম জিইয়ে রাখেন। ততদিনে তিনি তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছেন আমেরিকান বুদ্ধিজীবী মহলে। তিনি সেটিকেই কাজে লাগালেন। শিকাগোতে প্রতিষ্ঠা করলেন Bangladesh Emergency Welfare Appeal (BEWA) আর Bangladesh Defense League (BDL)। যখন BEWA উদ্বাস্তু মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত তখন BDL আমেরিকান সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমর্থন উঠিয়ে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।

আকাশচুম্বী অট্টালিকার জন্য বিখ্যাত হলেও ফজলুর রাহমান খান অন্য ধাঁচের স্থাপনা নকশাতেও তার কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। তার অন্যান্য স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হজ এয়ারপোর্ট টার্মিনাল, Macmath-pierce সোলার টেলিস্কোপ, Colorado Springs এর United States Air Force Academy, King Abdul Aziz University, Minneapolis এর Hubert H. Humphrey Metrodome, Milwaukee তে US Bank Center, New Orleans-এ One Shell Square তার নকশায় নির্মিত। তার স্থাপত্যশৈলী অনুপ্রাণিত করেছে World Trade Center, Petronas Towers, Jin Mao Building আর ১৯৬০ সাল থেকে নির্মিত প্রতিটি আকাশচুম্বী অট্টালিকার স্থপতিকে। এই একটি পদ্ধতি যা বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের অট্টালিকা নির্মাণের গতিপ্রকৃতি। খুব অল্প-কয়জন স্থপতির হাতে বিংশ শতাব্দীর স্থাপত্যের গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছে। তাদের মাঝে সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী এই একজন বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা ভাবনা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আকাশ ছোঁয়ার শক্তি।

ফজলুর রহমান খানের অট্টালিকার ডিজাইন আজো প্রতিটি স্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন একুশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থপতিতে। ২০১০ সালে যখন বুরজ খলিফা তৈরি করা শেষ হয়, তখন টেলিগ্রাফ পত্রিকা একে অভিহিত করে ফজলুর রাহমান খানের উচ্চাভিলাষী, হালকা নকশা দর্শনের প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে। এবং তার সম্পর্কে ওই নিবন্ধে বলা হয় যে, তিনি অতি উচ্চ অট্টালিকার অর্থনীতি আর কাঠামোটাকেই বদলে দেন। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা তার বক্তব্যে ফজলুর রহমান খানের অবদান তুলে ধরেন। তার মেয়ে ইয়াসমিন সাবিনা খানের ভাষায়, তার কাজের একটা ভালো ফলাফল আছে এই বিশ্বাসটাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করতো। আর তিনি অন্য প্রকৌশলীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতেন যেন তারা তাদের পেশার লক্ষ্য হারিয়ে না ফেলে। যখন তাকে Construction’s Man of the Year ঘোষণা করা হয় তখন তিনি বলেছিলেন,
“একজন প্রযুক্তির মানুষের কখনই উচিত হবে না শুধু প্রযুক্তির মাঝে ডুবে থাকা। তার অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে হবে। আর সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত অবশ্যই মানুষের মাঝেই প্রকৃত জীবন নিহিত”।

১৯৮২ সালের ২৭শে মার্চ। ৫২ বছর বয়সে ফজলুর রহমান খান সৌদি আরবের জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন। শিকাগো-বাসীর ভালবাসা তাকে অন্য কোথাও সমাহিত হতে দেয়নি। আর তিনি যতদিনে মৃত্যু বরণ করেন ততদিনে উন্নতির সোপান বেয়ে SOM ফার্মের একজন স্থপতি হিসেবে প্রথমবারের মতো General Partner পদ লাভ করেন। তার সকল গবেষণা পত্র আর ব্যক্তিগত কাগজ এর সংগ্রহ Ryerson & Burnham Libraries এর আওতায় রয়েছে। তার অর্জিত অসংখ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে,
“Wason Medal (1971), Alfred Lindau Award (1973), The Thomas Middlebrooks Award (1972), The Ernest Howard Award (1977), The Kimbrough Medal (1973), The Oscar Faber medal (1973), The International Award of Merit in Structural Engineering (1983), The AIA Institute Honor for Distinguished Achievement (1983), The John Parmer Award (1987), Hall of Fame from Illinois Engineering Council (2006), Man of the Year award -1972“.

১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয় বাংলার এই কৃতি সন্তানের নামে। তার সম্মানে Council on Tall Buildings and Urban Habitat প্রবর্তন করেছে Fazlur Khan Lifetime Achievement Medal।
তথ্যসূত্র-
১। http://mengineersnet.com/
২। https://drfazlurrkhan.com/
৩। https://en.wikipedia.org
৪। https://heavy.com/
৫। https://www.linkwaylive.com/
৬।https://www.telegraph.co.uk