নিঃসঙ্গতার আঁধারে বসে দেড় হাজার বছর!

0

কে এই ব্যক্তি যিনি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নানা রকম জপমালা আর মহামূল্যবান দামী পাথরের তৈরি কন্ঠহার পরে ছোট্ট একটা খুপরীর ভেতর একলা আঁধারে বসে রয়েছেন? কি তার পরিচয়? মধ্য আমেরিকার হন্ডুরাসে নিঃসঙ্গতায় দেড় হাজার বছর কাটানো এমন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মিলেছে সম্প্রতি আর আজকের আলোচনা তাকে ঘিরেই।

কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালানম্যাকা এবং তার সহকারী গবেষক দল হন্ডুরাসের কোপেনে সম্প্রতি ৭ম শতাব্দীর একটি সমাধি আবিষ্কার করেছেন। প্রাথমিকভাবে এটি প্রাচীন মায়া সমাজের শহুরে একজন অভিজাত ব্যক্তির কঙ্কাল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ম্যাকা’র মতে, সমাধিটির নির্মাণ, মানুষের কংকাল এবং কংকালের কাছে পাওয়া বস্তুগুলির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যসমূহ অনেকটা শহুরে, যা প্রাচীন সময়ের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে বেশি জটিল এবং সাংস্কৃতিকভাবেও বেশ ভিন্ন।

ম্যাকা, ক্রিস্টিনলান্ডু ( কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি ধারী ) এবং তাদের গবেষণা দল ২০০৫ সালে হন্ডুরাসের পশ্চিম প্রান্তের কাছাকাছি গুয়াতেমালার সীমান্তে অবস্থিত প্রাচীন শহর কোপেনে দুই বছর ধরে খননকার্য সম্পাদন করেন। এখন পর্যন্ত সমাধি এবং এ থেকে প্রাপ্ত বিষয়বস্তু সমূহ নিয়ে তারা অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন।

কোপেন চমৎকার সব প্রাচীন খোদাই শিল্প এবং খোদাই করা স্মৃতিস্তম্ভগুলির জন্য সুপরিচিত একটি নগর যেখানে রয়েছে আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘতম হায়ারোগ্লিফিক অংকিত সিঁড়ি। প্রাচীন কালের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য বহুল ব্যবহৃত অ্যাক্রোপলিসের ও দেখা মেলে এ শহরে। এসকল ঐতিহ্য ও বিশেষত্বের কারনে এ নগরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষনা করে।

কোপেন এর ধ্বংসাবশেষ

এত বিশেষত্বের পরেও ম্যাকার এই সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কার এ শহরে আরেকটি বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে কারন ম্যাকা এটি এমন এক অঞ্চল থেকে আবিষ্কার করেছেন যা শহরের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে বেশ দূরে। প্রধানত দূরত্বের কারনে আগে এইসব অঞ্চল নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি।

ম্যাকা বলেন, “অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে মিলিত হওয়ায়এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই আবিষ্কারটি ক্লাসিক যুগের (৬০০-৭৫০ খৃষ্টাব্দ) প্রথম দিকের। কোপেনের দীর্ঘসময়কালের রাজনৈতিক জটিলতা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমূহ এখানে চোখে পড়ার মত”।

কবরস্থ ব্যক্তির কংকালটি ঋজু অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়। কংকালটি ঝিনুক খোলস, মৃন্ময় পাত্র এবং মূল্যবান অলংকার ও পুঁথি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কংকালের অবস্থান, শরীরের কাছাকাছি এ সকল জিনিসপত্র এবং সমাধির অনন্য গঠনশৈলির কারনে ম্যাকা ধারণা করেন এটি কোন উচ্চ অভিজাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অথবা তৎকালীন কোন বিখ্যাত পুরোহিত ব্যক্তির কংকাল হয়ে থাকবে।

মৃত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন মাপের জপমালা, একটি পিকদার বা খোদাইয়ের দুল এবং গলা থেকে ঝুলন্ত একটি বিস্তৃত মূল্যবান পাথরের কন্ঠহার ছিল। তৎকালীন সামাজিক অবকাঠামো ও শ্রেনী বিন্যাস নিয়ে বিশদ গবেষণাকারী ম্যাকা বলেন, এখানে যে সকল মূল্যবান পাথরের উপস্থিতি দেখা যায় তা সুনিশ্চিত ভাবে “অর্থনৈতিক সম্পদগুলির উপর নিয়ন্ত্রণের মাত্রা” নির্দেশ করে। যা ঐ ব্যক্তির ছিল। তিনি আরও যোগ করেন, উপরন্তু, “মৃত ব্যক্তির বক্ষের উপর খোদাই করা নকশা সম্ভবত একটি রাজনৈতিক পরিচয় বা সামাজিক সংযুক্তির চিহ্ন যা ঐ ব্যক্তিটি শহরের অন্যান্য প্রধান বিষয়গুলোর সাথে যে সংযুক্ত ছিল তা নিশ্চিত করে।”

ম্যাকার মতে, কবরটি একটি বিরল প্রকৃতির নকশায় তৈরি যা পরস্পর আবদ্ধ হওয়া কবাট (ভারবাহী অনুভূমিক সমর্থন) দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী মন্দিরের পৃষ্ঠ থেকে নেমে আসা একটি সরু ও লম্বা পাথরের মাধ্যমে উপরে থেকে সমাধির ভেতরে প্রবেশ করা যেত। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য করে পূজা পার্বন সম্পন্ন করার জন্য যাতে এর মাঝে প্রবেশ করা যায় এ কারনে হয়ত এমন প্রবেশ দ্বার রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, তার অনুসন্ধানী দল দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে যে, কবরটিতে অন্তত একবার হলেও পুনঃপ্রবেশ করা হয়েছিল এবং ঐ ব্যক্তির কংকালের হাড় নিয়ে যজ্ঞ করা হয়েছিল।

তার মতে, “এই সমাধিসৌধটি কোপেনের আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রের বাইরে আবিষ্কৃত প্রথম সমাধিসৌধ যেখানে মায়া সভ্যতার পূর্বসূরিদের সমাধিসৌধের কিছুটা সাদৃশ্য নকশা দেখা যায়।” ম্যাকা আরও বলেন, “এই সমাধিটি এতোটাই রহস্যজনক যে আমরা প্রথমে কল্পনা করেছিলাম যে এটি শুধুমাত্র একটি রাজার সমাধি হতে পারে। তবে এখন আমরা বিশ্বাস করি যে এর আসল রহস্য আরও জটিল। ”

কোপেনের রাজবংশ,রাজকীয় আদালতের কর্মকর্তা এবং রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের এ জাতীয় সুসজ্জিত কবরগুলি সাধারণত অ্যাক্রোপলিসে পাওয়া যায়। তাই ১৮০০ সাল থেকে পুরাতত্ত্ববিদরা এসব কবরের খোঁজে অ্যাক্রোপলিস অঞ্চলে বেশিরভাগ গবেষণা ও খননকার্য পরিচালনা করেছেন।

অ্যাক্রোপলিস

“আমরা যখন প্রাচীন অভিজাত শহরের বিস্তৃতি এবং এটি কিভাবে আধুনিক আগ্রাসন ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল বিষয়ে বিশদভাবে ভাবতে শুরু করি তখন দেখতে পাই যে, রাজবংশের মূল ক্ষমতা কোপেন উপত্যকায় বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল যার অকাট্য প্রমাণ এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি ।” ম্যাকা বলেন।

“অ্যাক্রোপলিসের পূর্ববর্তী গবেষণা সমূহ কোপেনের ক্ষমতার উচ্চক্রম সম্পর্কে অনেক স্বচ্ছ ধারণা দেয় যেখানে মনে করা হয় মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রাজারা এবং তাদের প্রাসাদ গুলো ছিল সকল কেন্দ্রীয় ক্ষমতার আধার। তবে এখন আমরা এ সকল আবিষ্কার থেকে শহরের কেন্দ্রস্থলের বাইরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন ও শ্রেনীবিভাগের নতুন কিছু নমুনা দেখতে পাচ্ছি যা কোপেনের ইতিহাসের একটি জটিল সময়ের ইঙ্গিত করে।”

তিনি বলেন, সমাধিটিতে নিম্নলিখিত অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি ছিলঃ

  • সমাধিস্থ ব্যক্তিটিকে খাড়া করে বসানো ছিল এবং তার পা দুটি হাঁটু বরাবর ভাঁজ করা ছিল । এ প্রক্রিয়ায় মৃতদেহ সমাধিস্থ করার নমুনা ক্ল্যাসিক যুগেও নিম্ন মায়া ভূমিতে দেখা যায়নি কখনো এবং  পরবর্তী সময়েও কোপেনে কখনো এমন পদ্ধতিতে কাওকে সমাধিস্থ করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
  •  ম্যাকার গবেষণা দলের অন্যতম একজন সদস্য অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট প্রার্থী ক্যাথারিন মিলার জানান যে, সমাধিস্থ ব্যক্তিটি একজন পুরুষ ছিলেন এবং মৃত্যুর সময় ঐ ব্যক্তিটি প্রায় ৫০ বছর বয়সী ছিলেন। তিনি ম্যাস্টোইডিটিস (ব্যাকটেরিয়া ঘটিত কানের প্রদাহ), কশেরুকা ও হৃদপিণ্ডের সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিলেন ও দীর্ঘস্থায়ী কিছু রোগের দ্বারা জীবদ্দশায় বেশ দূর্বল হয়ে মৃত্যুবরন করেন।
  • দাঁত বাঁধাই এবং দন্তবিন্যাস প্রাচীন মায়া সভ্যতায় ও অভিজাতদের মধ্যে খুব সাধারণ একটি ব্যাপার ছিল। তবে কবরস্থ ব্যক্তির দন্তবিন্যাসের ধরন কিছুটা আলাদা যা সচরাচর মায়া সভ্যতায় দেখা যেত না। এ থেকে ব্যক্তিটি কোপেন উপত্যকার দূরবর্তী কোন অঞ্চলেরও হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে যে তিনি অন্যকোন অঞ্চল থেকে দন্তবিন্যাস করিয়েছিলেন।
  •  মৃত ব্যক্তিটির শরীরের সাথে কবরস্থ কারুকার্যময় মৃৎপাত্রটির অঙ্কন শৈলি দেখে সম্ভবত সেটি দক্ষিণ অঞ্চল থেকে (হণ্ডুরাস সীমান্তের কাছাকাছি বর্তমান এল সালভাদরের পাশে) এসেছিল বলে মনে হয়। কারন এ ধরনের অঙ্কনশৈলী সম্বলিত মৃৎপাত্র সাধারণত কোপেনে দেখা যায়না। এ থেকে ঐ অঞ্চলের সাথে কোপেনের যে একটি যোগসূত্র ছিল তা অনুমান করা যায়।
  • সমাধিস্থ ব্যক্তিটির চারপাশে ঝিনুক খোলস গুলো এমনভাবে সাজানো ছিল যেন দেখে তা একটি মহাজাগতিক মানচিত্র মনে হয়। ঐমহাজাগতিক মানচিত্র সমাধিস্থ ব্যক্তিটিকে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নির্দেশ করে। সেখানে ঝিনুক খোলসের উপস্থিতি একই সাথে মায়া সভ্যতায় প্রচলিত পূরাণের বিশ্বাস এবং পানিপথে তাদের বানিজ্যের প্রসারতা প্রমাণ করে।
  •  আবিষ্কৃত সমাধি এবং এর সংশ্লিষ্ট মন্দিরটি একটি সম্পূর্ণ ইউনিট হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। এসব একটি সমাধিস্তম্ভের অংশ ছিল যা শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য শহর থেকে দূরে নতুন একটি শাখা হিসেবে আবির্ভূত হয়। ম্যাকা বলেন, “দীর্ঘ মেয়াদী সময়কালে কোপনের শহুরে সম্প্রসারণের সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত উভয় উপাদান হিসেবে এটি প্রথম ভাল প্রমাণ।”
  •  সর্বোপরি এ আবিষ্কারটি “একটি অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ প্রদান করে যা সপ্তম শতাব্দীর প্রাচীন শহরটির সমকালীয় ও সাংস্কৃতিক জটিলতার এবং কোপান উপত্যকার সমাধিস্তম্ভ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের মাত্রা প্রসারিত করতে সাহায্য করে”, তিনি বলেন।
  •  হোন্ডুরান নৃতত্ব ও ইতিহাস বিভাগের পরিচালক ডেরিও ইউরেক বিশেষ কিছু কারনে ম্যাকার দেওয়া তথ্যের সাথে সহমত পোষন করেন।

কারণসমূহঃ

“প্রধানত এটি প্রথম সমাধিস্থল যা মায়া সভ্যতার বেশিরভাগ সমাধিক্ষেত্রগুলো থেকে অনেক দূরে অবস্থিত” তিনি বলেন, “আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি যে, কোপেনের এমন এক প্রান্তীয় অঞ্চলে এমন একটি সমাধি থাকতে পারে”

তিনি বিশ্বাস করেন এই সমাধি নিদর্শনটির গঠনশৈলী মায়ান সভ্যতার সাথে সঙ্গতিপূর্ন নয়। তার মতে, “কোপেনের মায়া সভ্যতায় যেসকল অনন্য বৈশিষ্ঠ্য পাওয়া যায় তার সাথে এটির কোন মিলই নেই এবং এটি মায়া সভ্যতার সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক”। তিনি মনে করেন “সম্ভবত কোন সাংস্কৃতিক মিশ্রন ঘটেছিল এখানে ।”

তথ্যসূত্রঃ

https://www.sciencedaily.com

https://news.nationalgeographic.com

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More