প্ল্যানচেট: মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগের পন্থা নাকি মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া?

2

প্ল্যানচেট, ফ্রেঞ্চ শব্দ যার অর্থ দাঁড়ায় “ছোট কাঠের টুকরো”, সাধারণত হৃদয়াকৃতির ছোট একটি কাঠের টুকরোকে বুঝায় যার চাকা বিশিষ্ট দুইটি পায়া এবং একটি পেন্সিল ধারণের ছিদ্র আছে। যার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখনী সহজতর হত। রহস্যময় বার্তা লিখন পদ্ধতিতে প্ল্যানচেটের ব্যবহার এই বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে, এই যন্ত্রটি আত্মাদের সাথে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। প্ল্যানচেট এর চূড়ান্ত বিবর্তনের আগে, অর্থাৎ এর সরল, পেন্সিল বিহীন পয়েন্টার সহ ওউইজা বোর্ডে পরিণত হওয়ার আগে ভিক্টোরিয়ান যুগে প্রেতের গবেষকদের বৈঠকে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ওউইজা বোর্ডে পরিণত হওয়ার পর আদি প্ল্যানচেট যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তাতে অনেকটা ভাটা পড়ে। অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সমর্থকদের বিশ্বাস যে, প্ল্যানচেটের বিচলনের কারণ আত্মার উপস্থিতি অথবা রহস্যময় কোন শক্তির প্রভাব।

আর এক সময়ের জনপ্রিয় এই প্ল্যানচেট এর ইতিহাস ও বিবর্তন নিয়ে আজকের আয়োজন।

প্ল্যানচেট
প্ল্যানচেট
Source: BrainCharm

ইতিহাস

আমেরিকাতে প্ল্যানচেটের উত্থান ঘটে আধ্যাত্মবাদের প্রসারের সাথে, যা শুরু হয়েছিল ১৮৪৮ সালে ফক্স বোনদের আত্মার সাথে যোগাযোগ করার অতিরঞ্জিত ক্ষমতার সংবাদের মাধ্যমে। এই ঘটনার ফলে সেই বছর অতিপ্রাকৃতিক থিম যুক্ত পার্টি গেইম, প্রেতসাধক এবং আত্মাদের সাথে যোগাযোগের অনুশীলন ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় হয়। এই সব অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করত তারা অদ্ভুত সব ঘটনার সাক্ষী হত- কখনও টেবিল নিজে নিজে নাড়াচাড়া করত, আবার কখনও কোন প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ-বোধক বা না-বোধক টোকা শোনা যেত।

১৮৫২-৫৩ সালের দিকে ইউরোপে আধুনিক আধ্যাত্মবাদ এবং আত্মার সাথে যোগাযোগের প্রসার ঘটে। ধরে নেয়া হয়, ১৮৫৩ সালে বিখ্যাত ফরাসি আধ্যাত্মবাদী মি. প্ল্যানচেট এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন এবং নিজের নামে নামকরণ করেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ফরাসি আধ্যাত্মবাদীরা বিশেষ ভাবে এই যন্ত্র ব্যবহার করেন। ১৮৫৩ সালে ইউরোপে প্ল্যানচেট এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, এর জনপ্রিয়তা ভিভিয়ের এর বিশপের নজরে আসে এবং সেই বছরই তিনি প্ল্যানচেট ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি প্যাস্টোরাল চিঠি পেশ করেন। আধ্যাত্মবাদে বেশ উচ্চ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত প্ল্যানচেট বিশেষ একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং কুটির শিল্পের মত ছোট পরিসরে অথবা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র নির্মাতাদের বিশেষ অনুরোধে এর উৎপাদন হত।

প্ল্যানচেট
Source: Tenor

প্ল্যানচেট আমেরিকাতে পৌঁছায় ১৮৫৮ সালে যখন আধ্যাত্মবিদ এবং সমাজ কর্মী রবার্ট ডেল অউয়েন এবং তার বন্ধু ড. এইচ এফ গার্ডনার প্যারিসে প্ল্যানচেটের ব্যবহার দেখেন। পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে আমেরিকার খেলনা নির্মাতাদের একটি সংগঠন এই ধারণার ভিত্তিতে অনেকগুলো প্ল্যানচেট তৈরি করে এবং বইয়ের দোকানগুলোতে বিক্রি করার জন্য চালান দেয়। আমেরিকা এবং গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য হিসেবে প্ল্যানচেট খ্যাতি অর্জন করে। প্ল্যানচেট উৎপাদন করা কয়েকটি কোম্পানি হল: Selchow & Righter, George G. Bussey, Jaques & Sons, Chad Valley এবং বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান Alexander।

আধ্যাত্মবাদীদের কাছে প্ল্যানচেট হল আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করার একটি মাধ্যম, আর ফলরূপে পাওয়া যেত স্বয়ংক্রিয় লেখনী। কয়েকজন মিডিয়ামের প্রকাশিত বইগুলো, তাদের ভাষ্যমতে, লেখা হয়েছিল যখন তারা প্ল্যানচেট ব্যবহারের সময় আত্মা দ্বারা বশীভূত ছিল। এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন সামুয়েল গাপি, ১৮৬৩ সালে “অ্যা চাইল্ড অ্যাট স্কুল” ছদ্মনামে লেখা মেরি জেন: অর স্পিরিচুয়ালিসম কেমিক্যালি এক্সপ্লেইন্ড  বইয়ে। তিনি বইটিতে উল্লেখ করেন যে, মানবদেহ হল ঘনীভূত গ্যাসের আধার যা প্রতিনিয়ত অদৃশ্য বৈদ্যুতিক বাষ্পের মত চামড়ার মধ্য দিয়ে নির্গত হয়। যখন এই বাষ্প প্ল্যানচেটের সংস্পর্শে আসে তখন এই “বাষ্প” “ওডিক শক্তি”তে রূপান্তরিত হয়ে প্ল্যানচেটকে সচল করে। তিনি আরও বলেন যে, কিছু মানুষের শরীরে অতিমাত্রায় ফসফরাস থাকে যার ফলে নির্গত বাষ্প জীবিত, চিন্তা করতে সক্ষম একটি দেহের মত আচরণ করে যা একটি পেন্সিল চালনা করার জন্য যথেষ্ট।

প্ল্যানচেট
Source: The Mysterious Planchette!

প্ল্যানচেটের বিবরণ ও বিবর্তন

প্রাথমিক ব্রিটিশ প্ল্যানচেট, ১৮৫০-৬০
প্রাথমিক ব্রিটিশ প্ল্যানচেট, ১৮৫০-৬০
Source: Michael J Wilson

আকৃতিভেদে প্ল্যানচেট বিভিন্ন হয়ে থাকে। ৯ ইঞ্চি মোটা বর্গাকৃতির কার্ডবোর্ডে অক্ষর এবং ১-১০ পর্যন্ত সংখ্যা ছাপা প্ল্যানচেট হল ডায়াল প্ল্যানচেট। এই ধরনের প্ল্যানচেটে “হ্যাঁ”, “না”, “বিদায়” এবং “জানি না” লেখাও ছাপা থাকে। এই অক্ষর, সংখ্যা এবং শব্দগুলো ৭ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট বৃত্তের বাইরের অংশে ছাপা থাকে এবং এই বৃত্তের মাঝখানে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ বর্গাকৃতির একটি কাঠের টুকরা দৃঢ় ভাবে কার্ডবোর্ডের সাথে আটকানো থাকে। এই কাঠের টুকরার উপরের অংশে একটি বৃত্তাকার চ্যানেল থাকে যার মধ্যে বলগুলো নাড়াচাড়া করে। বলের উপরে ৫ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট বৃত্তাকার কাঠের টুকরা সংযুক্ত থাকে এই পয়েন্টার এর বাইরের প্রান্তে। নিচের অংশের সাথে উপরের অংশ সাধারণ একটি স্ক্রু দ্বারা যুক্ত থাকে, যেখানে যোগাযোগের সময় উপরের প্লেটটি ঘূর্ণায়মান হয়।

১৮৬০ সালের প্ল্যানচেটের বিজ্ঞাপন
১৮৬০ সালের প্ল্যানচেটের বিজ্ঞাপন
Source: Pinterest

প্ল্যানচেটের আরেকটি ফর্ম হচ্ছে ওউইজা বোর্ড। ওউইজা বোর্ডের উপরে বর্ণমালার অক্ষরগুলো ছাপা থাকে এবং সেগুলোর উপর দিয়ে সহজেই পয়েন্টার নাড়াচাড়া করতে পারে, যা সঞ্চালিত হয় মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তির দ্বারা। ১৮৯০ সালের ১ জুলাই কেনার্ড নোভেলটি কোম্পানি এর একটি বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ওউইজা বোর্ডের প্রসার ঘটে এবং ওউইজা বোর্ডের জনপ্রিয়তা মূল প্ল্যানচেটকে ছাড়িয়ে যায়। যদিও প্রথম দিকের খবরে ওউইজাকে প্ল্যানচেট বলা হয়, পরবর্তীতে প্রত্যক্ষদর্শীরা খুব সহজেই প্ল্যানচেট এবং ওউইজা এর পার্থক্য বের করে ফেলে। যেখানে আগে প্ল্যানচেটের মাথায় পেন্সিল আটকানোর জন্য ছিদ্র থাকতে, ওউইজা তে রূপান্তরিত হয়ে পেন্সিল বিহীন পয়েন্টারের চল শুরু হয়। বোর্ডের নকশার পরিবর্তন, চমৎকার ভাবে ভার্নিশ করা বোর্ড এবং স্পষ্ট করে ছাপানো অক্ষরগুলোর কারণে ২৩ বছর আগের প্ল্যানচেটের মতই সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কিভাবে কাজ করে এই প্ল্যানচেট

ওউইজা বোর্ড, ১৮৯১
ওউইজা বোর্ড, ১৮৯১ Source: eBay

প্ল্যানচেটে থেকে প্রাপ্ত বার্তাগুলোর পেছনে দুইটি কারণ বর্তানো যায়- এক, আত্মাদের সাথে যোগাযোগের ফল অথবা, দুই, কোন ব্যক্তির অবচেতন মনের মানসিক প্রক্রিয়া। সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে, প্ল্যানচেট ব্যবহারের সময় সঞ্চালকের পেশির অবচেতন সঞ্চালনের দরুন যোগাযোগের প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে, কিন্তু প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে টেবিলের স্থান পরিবর্তন বা ডোসিং (Dowsing) এ ব্যবহার করার ডিভাইনিং রডের নাড়াচাড়া করার ব্যাখ্যার জন্য এই কারণগুলো ঠিক যথেষ্ট নয়।

প্ল্যানচেট ব্যবহারের জন্য প্রথমে একজন ব্যক্তি আত্মাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে তাদের আঙ্গুল প্ল্যানচেটের উপর স্থাপন করে। তারপর আত্মা “হয়ত” তাদের হাতগুলো ওউইজা বোর্ডের উপর অঙ্কিত অক্ষর আর সংখ্যার উপর নিয়ে যায় এবং আত্মাকে করা প্রশ্নের উত্তর দেয়। যারা আত্মার সাথে যোগাযোগকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়, তারা অনেক সময় ওউইজা বোর্ড ব্যবহারের সময় সব ধরনের বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দেয় যাতে আত্মার সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে। আর প্ল্যানচেট ব্যবহারের সময় মোমবাতির ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু সবাই যে প্ল্যানচেটের এই ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী, তা নয়। অনেকের মতে, আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই এবং এই সবকিছুই ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু না। তবে বিজ্ঞানের কাছে এই রহস্যের সম্ভাব্য কিছু ব্যাখ্যা আছে। বিজ্ঞানের মতে, প্ল্যানচেটের নিজে নিজে নাড়াচাড়া করার পেছনে কোন আত্মার নয়, মানুষেরই হাত আছে। প্ল্যানচেটের মধ্য দিয়ে যা ঘটে থাকে তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ইডিওমোটর ইফেক্ট; যখন কেউ অবচেতন মনে কোন বস্তু অথবা নিজের স্থান পরিবর্তন করে। এই ঘটনা তখনি ঘটে, যখন কিছু জানার প্রবল আগ্রহ প্ল্যানচেটের খেলোয়াড়ের অবচেতন মনের উপর প্রভাব ফেলে। আর ফলস্বরূপ খেলোয়াড় নিজের অজান্তেই প্ল্যানচেট সরিয়ে প্রত্যাশিত উত্তর তৈরি করে নেয়।

প্ল্যানচেট
Source: Etsy

তবে সবকিছু আরও অদ্ভুত হয়ে ওঠে যখন ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলোম্বিয়ার গবেষকেরা ইডিওমিটার ইফেক্ট এর উপর হ্যাঁ-বোধক এবং না-বোধক প্রশ্নের একটি গবেষণা চালায়। যাদের উপর এই গবেষণা চালান হয়েছিল তাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং তাদের বলা হয়েছিল যে তাদের পার্টনাররা প্ল্যানচেটের সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু গবেষণা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পার্টনাররা তাদের হাত সরিয়ে নেয়। এই পরীক্ষা চালানোর পর দেখা যায় যে, সামনাসামনি যে প্রশ্নগুলোর ৫০% সঠিক উত্তর পাওয়া যেত, প্ল্যানচেটের ব্যবহারের ফলে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬৫%, অর্থাৎ, প্ল্যানচেট ব্যবহারের কারণে মানব মস্তিষ্কের অবচেতন অংশের তথ্যগুলো ওউইজা বোর্ডে ছাপা অক্ষরের মাধ্যমে  বের হয়ে আসে।

প্ল্যানচেটের নিয়মাবলী

প্ল্যানচেট একসময় জনপ্রিয় পার্টি গেম হিসেবে বিবেচ্য হলেও পরবর্তীতে কালো জাদুর যন্ত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর এ কারণে “বিপজ্জনক” প্ল্যানচেট খেলার বেশ কিছু নিয়ম প্রচলিত আছে। সেগুলো নিম্নরূপ-

১. ওউইজা বোর্ড খেলা যাবেনা।

২. ওউইজা কখনও একা খেলা যাবে না।

৩. শয়তানকে পালাতে দেয়া যাবে না।

৪. ওউইজা বোর্ডে রুপার মুদ্রা রাখতে হবে।

৫. কখনও ঈশ্বরের কথা জিজ্ঞাসা করা যাবে না।

৬. সবসময় বিদায় নিতে হবে।

বর্তমান যুগে হালের ক্রেজ বলতে যা বুঝায়, সেই সময় প্ল্যানচেটও ছিল তেমন কিছু। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও করতে হবে এমন এক ট্রেন্ড ছিল ওউইজা বোর্ড গেম এবং প্ল্যানচেট। তবে প্ল্যানচেটের ব্যাপারে কোন তথ্য না মানা গেলেও একটা বিষয় যা মানতেই হবে তা হল, প্ল্যানচেট মানুষের অবচেতন মনের বুদ্ধিমত্তা এবং ভাবপ্রবণতার প্রকাশক।

Source Featured Image
Leave A Reply
2 Comments
  1. Wamgml says

    buy terbinafine 250mg online – brand griseofulvin 250mg griseofulvin over the counter

  2. Bdkcbf says

    order semaglutide 14mg for sale – order DDAVP for sale order DDAVP generic

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More