ফ্রান্স তখন দুর্দশার শিকার । যাজক শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর চাপে রাজা যখন ফ্রান্সে রাজতন্ত্র স্থায়ী করছিলো, ঠিক তখন তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছিলো । যাজক শ্রেণী কদাচিৎ কর দিতো । ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে তাদের সাথে রাজার পৌইসির চুক্তি হওয়ার ফলে রাজা তাঁদের উপর কর বসাতে পারতেন না । অভিজাতরা নিজেদের ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর বলে দাবি করতেন । রাজা নিজেও ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্গত । রাজার এহেন স্বৈরাচারী মনোভাব, অভিজাত শ্রেণীর অহংবোধ ও যাজক শ্রেণীর ঔদ্ধত্য ফ্রান্সের অর্থনীতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখেছিলো । মধ্যযুগে সামন্ত প্রথার কারণে ফ্রান্সের সমজে শ্রেণীবিভক্তি দেখা দেয় । প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা যাজক শ্রেণী, অভিজাত শ্রেণী ও তৃতীয় শ্রেণী এ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলো ।
যাজক শ্রেণী :
অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা তিন শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিলো । যাজকেরা ছিলেন তন্মধ্যে প্রথম শ্রেণী । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষ ত্রিশ হাজার । যাজক শ্রেণীতেও ছিলো ভেদাভেদ । প্রাচীন যুগে এ অঞ্চলে যেমন হিন্দুদের মধ্যে বর্ণাশ্রম ও চতুরাশ্রম প্রথা তেমনি সেসময় ফ্রান্সে নানা প্রথার জন্ম হয়েছিলো । কৃষকদের উপর সামন্ত প্রথার ফলে নির্যাতন ছিলো অবর্ণনীয় । যাজকদের মধ্যেও ছিলো না মিল । উচ্চ যাজক ও নিম্ন যাজক এই দুই ভাগে সুবিন্যস্ত ছিলেন । এছাড়াও যাজকদেরকে দিতে হতো টাইদ বা ধর্ম কর বা গীর্জা কর যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ছিলো অমানবিক । ফরাসী মন্ত্রী নেকারের মতে, ফ্রান্সের গীর্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিলো ১৩ কোটি লিভর । খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গীর্জার জমির ফসল চড়া মূল্যে বিক্রয় করে অনেক লাভ হতো । গীর্জার এই বিপুল অর্থ উচ্চ যাজক বা বিশপ শ্রেণীই ভোগ করতো ।
অভিজাত শ্রেণী :
সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিলো অভিজাত শ্রেণী । ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের সংখ্যা ছিলো তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার । দেশের জনসংখ্যার ১ থেকে ১.৫ ভাগই ছিলো অভিজাতরা (Court Nobility) । এরা ছিলো বংশ মর্যাদার দাবিদার । স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায়ের । সুতরাং অভিজাতরাই সবসময় privilege ভোগ করতেন ।
“এরা ছিলো বংশ মর্যাদার দাবিদার । স্বয়ং রাজা ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায়ের । সুতরাং অভিজাতরাই সবসময় privilege ভোগ করতেন ।”
অভিজাতরা নিজেদের ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর বলে দাবি করতেন । ফরাসি রাজাও এ দলে থাকায় রাজার স্বৈরাচারীতা চরমে উঠেছিলো ।
অভিজাতদের মধ্যে বিভিন্ন উপগোষ্ঠী ছিলো – (১) প্রাচীন বনেদী ঘরের অভিজাত – রাজার সভাসদ, সেনাপতিও বিচার বিভাগের উচ্চপদ ; একচেঁটিয়া অধিকারে ছিলো রাজার মন্ত্রিপরিষদ, আইন পরিষদ, রাষ্ট্রদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলি । (২) গ্রামীণ অভিজাত – গ্রামাঞ্চলের জমিদার শ্রেণী এবং প্রাদেশিক সভায় প্রতিপত্তি খাটাতো ;
* গ্রামীন অভিজাতরা জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি ও সেই অনুপাতে তাদের আয়বৃদ্ধি না হওয়ায় ক্রমে ক্রমে দরিদ্র হয়ে পড়ে । এরা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে অনাগ্রহী ছিলো । (৩) চাকরিজীবী অভিজাত – ধনী বুর্জোয়াদের একাংশ সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের জন্য পার্লামেন্টের বিচারক ও প্রদেশের ইন্টেন্ডেন্টের পদ বংশানুক্রমিকভাবে ক্রয় করে নিতো । এসব পদ তারা বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ করতো ।
তৃতীয় শ্রেণী :
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী ব্যতীত ফ্রান্সের বাকি লোকেরা তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত । বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর প্রভৃতি সকলেই ছিলো তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত । তৃতীয় শ্রেণীকে তাই Unprivileged বা অধিকারহীন শ্রেণী বলা হয় । ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিলো ২৫ মিলিয়ন । এর মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগ ছিলো তৃতীয় শ্রেণী তথা Third state এর অন্তর্ভূক্ত ।
“ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিলো ২৫ মিলিয়ন । এর মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগ ছিলো তৃতীয় শ্রেণী তথা Third state এর অন্তর্ভূক্ত”
করব্যবস্থা ও জীবনপ্রণালী :
বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের সমাজ অধিকারভোগী ও অধিকারহীন এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলো । দেশের ভূ-সম্পত্তির শতকরা ৪০ ভাগ সুবিধাভোগী দুই শ্রেণীর বহাল নিয়ন্ত্রণে ছিলো । তাঁদেরকে ন্যায়সঙ্গত কর দিতে হতো না । যাজকরা খুব কমই কর দিতেন । ফলে করের বোঝা গিয়ে পড়ে অধিকারহীন শ্রেণী অর্থাৎ কৃষক, কারিগর এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর । ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের অর্থনীতিই এ অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য দায়ী ছিলো । ফ্রান্সে তিনটি প্রধান কর ছিলো, টেইলে বা ভূমি কর, ক্যাপিটেশন বা আয়কর এবং ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর । কিন্তু ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী যথাক্রমে এক-দশমাংশ ও এক-পঞ্চমাংশ ভূ-সম্পত্তির মালিক । তাছাড়া ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজার সাথে যাজক শ্রেণীর পৌ-ইসির চুক্তি হওয়ায় রাজা তাদের উপর কর আরোপ করতে পারতেন না । অভিজাতরাও ক্যাপিটেশন বা আয়কর এবং ভিংটিয়েমে বা উৎপাদন কর সুকৌশলে এড়িয়ে যেত । ইন্টেন্ডেন্ট নামক রাজকর্মচারীরা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলো ।
তিনটি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ গ্যাবেলা (Gabella) বা লবণ শুল্ক, বাণিজ্য শুল্ক প্রভৃতি কর আদায় করতো । রাজার কর আদায়ের একমাত্র উৎস ছিলো তৃতীয় শ্রেণী । ফলে তৃতীয় শ্রেণী করের যোগান দিতে গিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে । তাছাড়া যাজকদেরকে টাইদ (Tithe) বা ধর্ম কর দিতে হতো ফসলের এক-দশমাংশ জমির উপর । সামন্ত প্রভুদের জন্যে কর্ভি বা বিনা মজুরিতে কাজ করা, বানালিতে (Banalites) প্রভৃতি বাধ্যতামূলকভাবে কর দিতে হতো । এভাবে তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর কতৃত্ব করতে থাকে ফরাসী বুরবোঁ রাজবংশ ।
করবৃদ্ধির সাথে সাথে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি যেন প্রকট হয়ে ওঠে । একেই চতুর্দিকে কর দিতে দিতে নাজেহাল তার উপর বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন জনজীবনের নাভিশ্বাস আরো বাড়িয়ে তোলে ।
রাজা ও রাজন্যবর্গের অমিতব্যয়ীতা :
ফ্রান্সের অর্থনীতির ঘোর অন্ধকারময দিক হলো রাজকোষের যথেচ্ছা ব্যবহার । ঐতিহাসিক গুডউইনের মতে ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ; যাদের মধ্যে ১৬ হাজার কর্মচারী ছিলো কেবল রাজপ্রাসাদের কাজের জন্যই বহাল ছিলো । রাণীর খাস চাকরের সংখ্যা ছিলো ৫০০ । রাণী নিত্য-নতুন ভোজসভার আয়োজন করতেন এবং ভোজসভা ও পোশাকের পিছনে প্রচুর খরচ করতেন । রাজপরিবারের অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য রাজাকে বহু অর্থ ঋণ করতে হয় ।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স জার্মানীর সাথে সেডানের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ফ্রান্সের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। ফ্রান্সের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার এটাও একটি কারণ হতে পারে ।
শুধু আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থমন্ত্রী নেকার ঋণ নেন ১০০ কোটি লিভর । ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজাকে ঋণের সুদের দরুণ ৩১ কোটি ৮০ লাখ লিভর ব্যয় করতে হতো । এর সঙ্গে সরকারের অন্যান্য খরচ যুক্ত হলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ কোটি লিভর ।
রাজন্যবর্গের দূর্বলতা :
রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রি:) বিলাসব্যসনে মগ্ন থেকে স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন । তিনি দাম্ভিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমিই রাষ্ট্র” (I am the state.) তাঁর উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ছিলেন বিলাসী, অলস ও পরিশ্রমবিমুখ । “প্রজাপতি রাজা” বলে পরিচিত এই রাজা তাঁর রাণী উপপত্নী মাদাম-দ্য-পম্পদুয়্যরের প্রভাবাধীন ছিলেন । পঞ্চদশ লুইয়ের দূর্বলতার সুযোগে উপপত্নী পম্পদুয়্যর রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন প্রতিনিয়ত । এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রী ও অভিজাতদের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন । ঐতিহাসিক শেভিলের মতে, রাজার নামে অভিজাতরাই প্রশাসন চালাতে থাকেন । ফরাসী রাজসভা স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের লীলাভূমিতে পরিণত হয় ।
“তিনি দাম্ভিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমিই রাষ্ট্র” (I am the state.)”
ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন দূর্বল চিত্ত শাসক । তাঁর সময়ে রাজতন্ত্রে অবক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পায় । তিনি ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ । চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে কোনোভাবেই ছিলো না । তিনি ছিলেন প্রথম রাণী মাদাম-দ্য-তুসোর নিয়ন্ত্রণাধীন ও দ্বিতীয় রাণী মেরী এন্টোয়নেটের প্রভাবাধীন । সেকারণে তিনি পত্নী, অভিজাত, সভাসদ ও মন্ত্রী কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি ।
ফরাসি বিপ্লবের গতি যেমন ছিলো বৈচিত্র্যময়, তেমনই ছিলো ব্যাপক । ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ লুইয়ের পর ষোড়শ লুই ফ্রান্সের রাজা হন । ষোড়শ লুই ছিলেন ভোজনবিলাসী ও স্ত্রৈণ রাজা । পিতা ও পিতামহের ন্যায় তিনি স্বেচ্ছাচারী পথ অবলম্বন করেন । ক্রীড়নক ছিলেন মেরী এন্টোয়নেট ও মাদাম-দ্য-তুসোর । ক্রমাগত বহিঃশত্রুর মোকাবেলা ও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ফলে ফ্রান্সের রাজকোষ অচিরেই শূন্য হয়ে পড়ে ।
এসময় জনসাধারণের উপর করবৃদ্ধি করে ফ্রান্সের অচলাবস্থা মোচন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিলো না । ফলে টুর্গোকে নির্দেশ দেওয়া হয় আর্থিক সংস্কারের জন্য । তিনি ছিলেন দক্ষ ও সাহসী অর্থমন্ত্রী । তিনি ফ্রান্সে অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন, গিল্ড উচ্ছেদ ও কৃষকদের উপর থেকে বিশেষ কর উচ্ছেদের ঘোষণা দিলে অভিজাতবর্গ নাখোশ হন । বিদ্রোহ করতে থাকে অভিজাতরা । তাঁদের চাপে রাজা টুর্গোকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন । অতঃপর ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংকার নেকারকে টুর্গোর স্থলাভিষিক্ত করা হয় । তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতি ব্যয় সংকোচন নীতি প্রবর্তন ও ভূমি সংস্কারের চেষ্টা করেন । কিন্তু অভিজাতদের চাপের মুখে তিনিও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ।
নেকারের পদত্যাগের পর অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ক্যালোন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান । তিনি সরকারের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে অভিজাত ও যাজক শ্রেণী উপর কর ধার্যের প্রস্তাব করেন । এছাড়া তিনি ‘কর্ভি’ নামক বাধ্যতামূলক শ্রমদান নিষিদ্ধকরণ ও লবণ কর সকল শ্রেণীর উপর আরোপের প্রস্তাব দেন । তাঁর এ প্রস্তাব জনসাধারণের নিকট প্রশংসিত হলেও অভিজাতরা এর বিরোধিতা করেন । ষোড়শ লুই ক্যালোনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গণ্যমান্য অভিজাতদের সভা ডাকার নির্দেশ দেন । কিন্তু গণ্যমান্যরা সুবিধাভোগী থাকায় এ প্রস্তাব প্রত্যাখাত হয় । নিরুপায় রাজা ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী ক্যালোনকে পদচ্যুত করেন । ক্যালোনের পরে অর্থমন্ত্রী করা হয় ব্রিয়েনকে । পরিস্থিতির চাপে তিনি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হন । ব্রিয়েন রাজার নির্দেশ অনুসারে আর্থিক সংস্কারের প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে পেশ করলে এ প্রস্তাবও প্যারিসের পার্লামেন্ট নাকচ করে দেয় ।
প্রকৃতপক্ষে অভিজাত শ্রেণী তাঁদের স্বার্থ বহির্ভূত কর প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে থাকে একের পর এক । কিন্তু সেসময় ফ্রান্সের অর্থনীতি এতটাই করুণ দশায় গেছিলো যে সকল শ্রেণীর উপর কর আরোপ ছাড়া কোনো পথ ছিলো না । পরিস্থিতির উত্তোরণের জন্য রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলেন ।
স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন :
সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভার আয়োজন হয়েছিলো । ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এ জাতীয় সভার আহবান অবিস্মরণীয় অধ্যায় । কারণ এদিন থেকেই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো । এ রাজসভায় তখন মোট সদস্য সংখ্যা ছিলো ১২১৪ জন । এর মধ্যে যাজকদের সংখ্যা ছিলো ৩০৮ জন, অভিজাতদের সংখ্যা ছিলো ২৮৫ জন ও তৃতীয় শ্রেণীর সংখ্যা ছিলো ৬২১ জন । তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী । কিন্তু এ সকল সদস্যদের একটি করে ভোট ছিলো না । তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোনো লাভ হতো না । কেননা অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর বিরোধিতার জন্য রাজা তৃতীয় শ্রেণীর দাবি-দাওয়া মানতে রাজি হতেন না ।
কয়েকদিন অপেক্ষার পরেও রাজার কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না আসায় ১৭ জুন স্টেটস জেনারেলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ নিজেদেরকে ফ্রান্সের জাতীয় সভা ঘোষণা করে এবং কর ধার্যের অধিকার নিজেদের হাতে তুলে নেন । এমতাবস্থায় অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর চাপের মুখে রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদেরকে দমন করতে মনঃস্থির করেন । তিনি পুনরায় স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন । কিন্তু রাজার এ সিদ্ধান্তের কথা তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ জানতেন না । ফলে ২০ জুন তারা এসে দেখেন সভাগৃহ বন্ধ রয়েছে এবং প্রবেশপথে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে । তখন তারা বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে উপস্থিত হন এবং সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন । সেখানেই তারা ঐতিহাসিক শপথ নিয়েছিলো যে যতোদিন তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করতে না পারবেন ততোদিন পর্যান্ত তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন ।
এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই ২৩ জুন স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহবান করে জাতীয় সভার কর্মকাণ্ডকে বেআইনী বলে ঘোষণা করেন এবং প্রতিনিধি সভার তিনটি শ্রেণীকে পৃথক পৃথক কক্ষে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন । রাজার এ ঘোষণার ফলে সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় । রাজার বক্তৃতা শেষ হলে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর সদস্যরা পরিষদকক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা কক্ষ ত্যাগ করেন নি । সভাগৃহে রাজার পরিচালক তাঁদেরকে সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বললে জননায়ক মিরাবো (Mirabeau) দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দেন, “আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বল প্রয়োগ ভিন্ন অন্য কিছুতেই সম্ভব নয় ।”
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা শেষ পর্যান্ত তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিগণকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন । রাজা কতৃক জনসাধারণের দাবি মেনে নেওয়ার ফলে তাঁদের প্রাথমিক সাফল্য লাভ হয় । এভাবে বিপ্লবের গতি সর্বাগ্রে সহজ ও অপ্রতিহত হয়ে উঠলো । প্যারিস নগরী বিপ্লবের মঞ্চে পরিণত হলো । এসময় ফ্রান্সের অন্যত্র কৃষির অবনতি ও প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ শহরে কাজ ও খাদ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে । এসম বুভুক্ষু নরনারী প্যারিসে রুটির দোকান ও কারখানাগুলো বিধ্বস্ত করতে থাকে । ইতঃপূর্বে শহরে সশস্ত্র ডাকাত দলের আবির্ভাব ঘটে ও যত্রতত্র লুটতরাজ করতে থাকে । রাজা ষোড়শ লুই প্যারিস নগরীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয় ।
ভীতসন্ত্রস্ত রাজা আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিচলিত হয়ে ভার্সাই নগরীর নিকট সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন ২৭ জুন । শুরু হয় জনতার সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ । শীঘ্রই প্যারিসের নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের হাতে চলে যায় । রাস্তায় রাস্তায় গড়ে ওঠে ব্যারিকেড ও লুট হতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান ।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেয় উন্মত্ত জনতা । তারা বন্দিদিগকে মুক্ত করে কারাগারের অধিকর্তাকে হত্যা করে । বাস্তিল দুর্গের পতনের সাথে সাথে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমাধি প্রতিষ্ঠা হয় ।
এ দুর্গের পতনের সাথে সাথে প্যারিসের শাসনভার বিপ্লবীরা নিজেদের হাতে তুলে নেয় । তারা নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে ‘প্যারিস কমিউন’ নামে অস্থায়ী পৌর পরিষদ গঠন করে । প্যারিস নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিপ্লবীরা ন্যাশনাল গার্ড নামে এক জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করে । প্যারিসের ন্যায় ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরণের কামিউন গঠিত হয় ।
এ দুর্গ পতনের সাথে সাথে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় । ভেঙে ফেলতে থাকে শোষণের যন্ত্রপাতি । এসময় গুজব রটে, শহর থেকে অভিজাতরা ভাড়াটিয়া লুটেরা শ্রেণী পাঠিয়ে গ্রামগুলোতে শস্যক্ষেত পুড়িয়ে দিচ্ছে । ফলে কৃষকরা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয় ও তাদের সামন্ত প্রভুদের হত্যা করতে থাকে । কৃষকদের এই অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থানে যজক ও অভিজাত শ্রেণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশন বসে এবং ১১ আগস্ট একাধিক আইন পাশ করে ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী তাদের পূর্বতন সকল সুবিধা প্রত্যাহার করেন । এর ফলে পূর্বতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ও ফ্রান্সের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা হয় ।
বিপ্লবের গতিধারা ক্রমশ অনমনীয় হয়ে ওঠে । বিপ্লবের ফলে প্যারিসের খাদ্য সংকট (Food Crisis) তীব্র আকার ধারণ করে । বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় । এমতাবস্থায় খাদ্যাভাব চরমে পৌঁছলে ৫ অক্টোবর প্যারিসের কয়েক হাজার স্ত্রীলোক খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই নগরীর দিকে রওনা হয় । এদের সঙ্গে লাফায়েলের নেতৃত্বে ২০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড ভার্সাইয়ে যায় । মিছিল ভার্সাই নগরে উপস্থিত হয়ে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করলে দুজন রক্ষী নিহত হয় । যাই হোক, এসময় লফায়েৎ ২০ হাজার জাতীয় রক্ষীদের সাহায্যে উন্মত্ত জনতার কবল থেকে প্রাসাদ রক্ষা করেন । ষোড়শ লুই বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে জাতীয় পরিষদের সব আইনগুলিতে সম্মতি দেন । অতঃপর নারী জোট ও লাফায়েতের নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষী বাহিনী রাজা, রাণী ও তাঁদের বালক পুত্রকে নিয়ে মিছিল করতে করতে প্যারিস নগরে আসে । এই ঘটনা ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা’ বলে পরিচিত ।
ফ্রান্সের বিভাজন, রাজা ও অভিজাতদের জনবিচ্ছিন্নতা :
শুরু থেকেই বলে আসছি যে এ বিপ্লব ছিলো নতুন ভাবাদর্শ, চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব । এ বিপ্লবে তাই দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য ছিলো । দার্শনিক হলব্যখ আধ্যাত্মিক ও ঈশ্বর চিন্তা অপেক্ষা বস্তুজগতে মানুষের কল্যাণকেই প্রাধাণ্য দেন । তিনি বলেন, “ আদিতে মানুষ সুখী ছিলো । রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনাচারের জন্যই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বেড়েছে । ” হেল ভিসিয়াস বলেন, “ মানুষের মঙ্গল বিধানই সকল চিন্তার মূল কথা । ”
সেসময় দার্শনিকরা মনে করতেন যে রাষ্ট্র ও সমাজের পশ্চাতে যে নিয়মগুলি (তন্ত্র-মন্ত্র) কাজ করে তা শুধু আবিষ্কার করলেই চলবে না ; তাকে প্রয়োজনমতো সংস্কার করতে হবে । তাঁরা প্রাকৃতিক আইন ও যুক্তিবাদকেই গুরুত্ব দিতেন । একই সাথে ভাবতেন ধর্মসহিষ্ণুতার কথা । ইংরেজ দার্শনিক ভ্যালক এই উদারনৈতিক বুদ্ধি বিভাসার সূত্রপাত করেন । পরে ফরাসি দার্শনিকরা এই ভাবধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান ।
মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) :
ফ্রান্সের প্রাক-বিপ্লব যে সমস্ত দার্শনিক মতবাদ প্রবর্তন করেছেন তাঁদের মধ্যে মন্তেস্কুর নাম উল্লেখযোগ্য । তাঁর মতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজ-বংশ ও অভিজাত শাসনব্যবস্থা ছিলো যুক্তি বহির্ভূত । ছিলেন ব্রিটিশ সংবিধানের বিশেষ অনুরাগী । পারস্যের পত্রাবলী (Persian Letter) ও স্পিরিট অব লজ বা আইনের মর্ম (Spirit of Laws) তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ । পারস্যের পত্রাবলী (Persian Letter) গ্রন্থে সামন্ত প্রথার ফলে ফ্রান্সের তদানিন্তন সমাজব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী শাসনের যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করেছেন । প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রের গৎবাঁধা নিয়ম ও অন্যায় করপ্রথা এবং অযৌক্তিক দিকগুলি সুনিপুণভাবে ব্যাখ্যা করেন স্পিরিট অব লজ বা আইনের মর্ম (Spirit of Laws) গ্রন্থে । এ ক্ষেত্রে কেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা কাম্য সে বিষয়ে তিনি মত প্রকাশ করেন । তাঁর এই মতবাদকে ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব বলা হয় । তিনি এই গ্রন্থে ফ্রান্সের স্বর্গীয় অধিকার নীতিকে নস্যাৎ করেন । তিনি বলেন যে – “ যদি একই ব্যক্তির হাতে সরকারের আইন, বিচার ও কার্যনির্বাহী বিভাগ ন্যস্ত থাকে তবে রাষ্ট্রের ব্যক্তিস্বাধীনতা লোপ পাবে । ” তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসন ও আইন বিভাগকে পৃথক করার পক্ষপাতী ছিলেন ।
ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) :
পাণ্ডিত্য অগাধ । বিরুদ্ধে ছিলেন গীর্জার দুর্নীতির । লিখেছেন অসংখ্য ব্যঙ্গ রচনা । ব্যঙ্গ করেছেন ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্রের প্রতি । ভেবেছেন সম-অধিকারের কথা । “ফিলোসফিক্যাল ডিকশনারী” নামে একটি অভিধান ও “কাঁদিদ” নামে একটি উপন্যাস উল্লেখযোগ্য । তিনিও মন্তেস্কুর ন্যায় ছিলেন স্বর্গীয় অধিকার নীতির ঘোর সমালোচক ।
জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো :
দর্শনের চূড়ামণি জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো ছিলেন মৌলিক ও বৈপ্লবিক মতের প্রবক্তা । বিখ্যাত রচনা “Social Contract” এ বিশ্লেষণ করেছেন কীভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হলো, কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় । তিনি ঐতিহাসিক প্রমাণের সাহায্যে এই সত্য প্রচার করেন, ঈশ্বর রাজা বা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেন নি । জনসাধারণই রাষ্ট্রের উৎস । রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি জনসাধারণের হাতেই আছে । রাজা জনমত অনুযায়ী চলতে বাধ্য সর্বদা ।
“Government of the people by the people for the people.”
লেফেভারের মতে, রুশোর আবেগী মতামত বস্তুবাদী, ব্যবহারবাদী দর্শনকে এক নতুন শক্তি দেয় । তাঁর সম্পর্কে এক সমালোচক বলেন যে, “ আমাদের সমাজ কীভাবে আছে, তাকে তিনি অতিক্রম করে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছেন । ” রুশোর অপর বিখ্যাত রচনা “ডিসকোর্স অন ইকোয়ালিটি” গ্রন্থে তিনি সামাজিক অসাম্যের কথা বলেন । এই গ্রন্থটি সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণায় পরিপূর্ণ ।
স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন :
সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামে জাতীয় সভার অধিবেশন বসে । এ অধিবেশনে ফ্রান্সের রাজকোষের অর্থাভাব ধরা পড়ে । এ দিক দিয়ে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের রাজা, মন্ত্রী ও অভিজাতদের দূর্বল দিক ফাঁস হয় ।
রাজতন্ত্রের শবযাত্রা :
অতঃপর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাজার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা বিজিত হয় । কারণ ২৭ জুন ষোড়শ লুই তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিগণকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন । এ সময় হতেই জাতীয় ফ্রান্সের জন্য নতুন সংবিধান রচনার কাজে ব্রতী হয় । এ কারণে তখন জাতীয় সভা সংবিধান সভায় পরিণত হয় । সংবিধান সভার সদস্যবর্গ বুদ্ধিমান থাকলেও ছিলো না তাঁদের কোনো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪-১১ আগস্ট সংবিধান সভা কতকগুলো বিধিবিধান সংযোজন করে সামন্ত প্রথা বিলুপ্ত করে।
মানবাধিকার সনদ ঘোষণা :
সংবিধান সভার দ্বিতীয় অবদান মানবাধিকার সনদ ঘোষণা । মূলত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও দার্শনিকদের রচনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এ সনদ রচনা করা হয়।
রাজার ক্ষমতা :
নতুন এই সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্স শাসন করার ক্ষমতা রাজা ও আইনসভার মধ্যে সমন্বয় করে দেওয়া হয় । রাজাকে দেওয়া হয় মন্ত্রী নিয়োগের অধিকার । তবে আইনসভার কোনো সদস্যের মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকলো না । এভাবে আইনসভা থেকে শাসন বিভাগ বিভক্ত করা হয় । নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাজা শুধু “ভেটো” (Suspensive Power) ব্যবহার করে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য কোনো আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখার ক্ষমতা লাভ করেন । মোটকথা, নতুন এই সংবিধানে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ করা হয় ।
আইনসভা :
৭৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠন করা হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা । মেয়াদ ধরা হয় ২ বছর । আইন প্রণয়নের পূর্ণ অধিকার লাভ করে আইনসভা ।
শাসন বিভাগ :
শাসনকার্যের সুষ্ঠু অধিকারের ভিত্তিতে পুরাতন প্রদেশ বাতিল করে ৮৩ টি বিভাগ গঠন করা হয় । প্রত্যেক বিভাগ ও কয়েকটি জেলাকে ক্যান্টন ও কমিউনে বিভক্ত করা হয় । এভাবে সমগ্র ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করা হয় ।
গীর্জার পুনর্গঠন : গীর্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও সংবিধান-সভা ফ্রান্সে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় সমাধানের জন্য ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে যাজকদের নাগরিক সংবিধান পাশ করে গীর্জার সকল স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করা হয় । * যাজক নির্বাচনে পোপের হস্তক্ষেপ আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় । ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর সংবিধান সভা বাতিল ঘোষণা করা হয় ।
রাজতন্ত্রের পতন :
সংবিধান সভা বন্ধের পর প্রথম সমস্যা নাগরিক সংবিধানের প্রতি যেসব যাজক অসম্মতি প্রদান করবে, তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । ভাতা, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বিদ্রোহী ধর্মযাজকদের উপর থেকে নাকচ করে নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয় । দ্বিতীয় সমস্যা এমিগ্রি অর্থাৎ ফ্রান্সের রাইন সীমান্তে সৈন্য সংগঠন করে বিপ্লবী সরকারকে আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে এমিগ্রিরা । এদের সম্পর্কে বিধানসভা সিদ্ধান্ত নেয় ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারীর মধ্যে তাদের ফিরে আসতে বলা হয় । যারা এই আদেশ অমান্য করবে তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে । এই দুটি সিদ্ধান্ত রাজার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে তিনি ভেটো ক্ষমতাবলে নাকচ করে দেন । রাজার এই নিষেধাজ্ঞায় জিরন্ডিস্ট ও জ্যাকোবিন গোষ্ঠী ক্রুদ্ধ হয় । চরমপন্থীরা জাতীয় সভার উদারপন্থীদের বিরোধিতা শুরু করে । ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে কর্ডেলিয়ান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় । এই গোষ্ঠীর লোকেরা ছিলো উগ্রপন্থী । এর ফলে সাঁকুলেৎ শ্রেণীও নিজ শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয় । উগ্রপন্থীদের উস্কানীতে ফ্রান্সের উন্মত্ত জনতা ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করে ও রাজাকে অপদস্থ করে । এ আক্রমণের ফলে রাজা স্ব-নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হন । অস্ট্রিয়ার রাজা লিউপোল্ড তাঁর ভগ্নী ও ভগ্নীপতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন । রাজা ষোড়শ লুই, রাণী মেরী এন্টোয়নেট ও তাঁদের বালকপুত্র ছদ্মবেশ ধরে লুক্সেমবার্গ সীমান্তে মন্টমেডি দুর্গের দিকে পালিয়ে যান । কিন্তু সীমান্তের কাছে ভ্যারেন্নে গ্রামে এক ফরাসি রাজা ও রাণীকে চিনতে পারে ।তাঁরা রাজাকে আটক করে রাজধানীতে খবর দেয় । তীব্র ধিক্কার ও অপমানের মধ্য দিয়ে রাজা ষোড়শ লুই সপরিবারে প্যারিসে ফিরে আসেন । রাজা ষোড়শ লুইয়ের ভ্যারেন্নেতে পলায়নের পর তার বৈদিশিক শক্তি বিশেষত অস্ট্রিয়ার গোপন ষড়যন্ত্রের সন্দেহ উগ্রপন্থীদের মধ্যে দেখা দেয় । এই সময় ব্রান্সউইক ঘোষণার দ্বারা অস্ট্রিয়ার সেনাপতি সতর্ক করে দেন, ফ্রান্সের রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি হলে তিনি বিপ্লবীদের কঠিন শাস্তি দেবেন । উগ্রপন্থীদের অভিযোগ ওঠে রাজাদুটি শত্রু দেশ অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন । পলাতক রাষ্ট্রদ্রোহী এমিগ্রি ও বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে রাজার গোপন যোগাযোগের গুজব ছড়িয়ে যায় সর্বত্র । ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই জ্যাকোবিনদের প্ররোচনায় শাম্প দ্য মার – এ এক জনসভায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহবান করা হয় । এ মর্মে বিধানসভার কাছে একটি গণ আবেদন পাঠানো হয় । এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রিয়ার সম্রাট, রাণী মেরী এন্টোয়নেটের ভ্রাতা লিওপোল্ড ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট পিলনিৎসের ঘোষণা দেন যে যদি ইউরোপের সকল রাজশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ষোড়শ লুইকে রক্ষা এবং তাঁর হৃত ক্ষমতা পুনঃস্থাপনের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করবে । ঐতিহাসকদের মতে, পিলনিৎসের এই ঘোষণা ছিলো ফাঁকা হুমকি । কিন্তু এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে উগ্রপন্থী বিপ্লবীরা । তাঁরা রাজাকে বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করে ও রাজতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য মারমুখী হয় । জিরন্ডিস্টদের চপে বিধানসভা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । সভায় জিরন্ডিস্টরা “পিতৃভূমি বিপন্ন” এই ধ্বনি তুলে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে সদস্যদের ভোট পেয়ে যায় । কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই ফ্রান্সের সেনাপতি জেনারেল ডুমুরিয়েৎস বেলজিয়াম সীমান্তে পিছু হঠেন । ফলে রাজধানী প্যারিস বিপন্ন হয়ে পড়ে । অভিযোগ তোলা হয়, তিনি শত্রুপক্ষকে গোপনে ফ্রান্সের রণপরিকল্পনার খবর দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেন । ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের বিপ্লবী কমিউনের নেতৃত্তে টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করা হয় এবং রাজার সুইস দেহরক্ষী দলকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে । রাজা-রাণী প্রাণভয়ে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে আইনসভায় আশ্রয় নেন । ক্ষিপ্ত আইনসভা ঘেরাও করে রাজতন্ত্র বাতিলের দাবি জানায় । ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্র রদ করা হলে সকল রাজভক্ত পদত্যাগ করে । লেফেভার ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে গণভোট প্রথার প্রবর্তন ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন । সেই সাথে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদকে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব আখ্যা দেন ।
ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ড :
জাতীয় সম্মেলনের সম্মুখে প্রধান কাজ ছিলো সকল রাজতন্ত্রী ও ক্যাথলিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের দমন করা । ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান বাতিল হবার ফলে নতুন সংবিধান রচনা করা হয় । বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান রচিত হয়েছিলো । এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুইকে পদচ্যুত করা হয় । জনসাধারণ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাঁর প্রাণদণ্ডের পক্ষপাতী না হলেও জ্যাকোবিন দলের রোষের মুখে ষোড়শ লুইকে গিলোটিন যন্ত্রে শিরোশ্ছেদ করা হয় ।
দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমাদের পেইজ এ চোখ রাখুন। আগামীকালই দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে ।
how to buy prandin – order repaglinide sale empagliflozin 10mg cheap
micronase tablet – order glucotrol 5mg online order forxiga generic
buy metformin 1000mg without prescription – glucophage 1000mg oral order acarbose 25mg online cheap
buy desloratadine online – how to get flixotide without a prescription buy albuterol 4mg pills
cost of depo-medrol – cost depo-medrol oral astelin 10ml
buy ventolin tablets – buy fexofenadine tablets buy theo-24 Cr generic
ivermectin 6mg over the counter – where to buy aczone without a prescription order cefaclor 500mg sale
clindamycin pills – buy generic doxycycline order chloromycetin
purchase zithromax pill – order sumycin online cheap order ciprofloxacin generic
cheap amoxil generic – buy amoxicillin 250mg purchase ciprofloxacin online cheap
amoxiclav cost – buy myambutol 1000mg sale buy cipro 500mg pill
hydroxyzine over the counter – purchase atarax without prescription buy endep no prescription
buy quetiapine 50mg online cheap – buy luvox without a prescription eskalith order online
cheap anafranil – buy asendin 50 mg pill purchase sinequan for sale
retrovir 300 mg oral – lamivudine 100mg for sale zyloprim 300mg sale
buy generic clozapine 50mg – order famotidine without prescription buy famotidine 20mg
glycomet us – cefadroxil pill lincocin cheap
buy furosemide pills for sale – generic candesartan 16mg captopril oral
metronidazole buy online – cefaclor pills zithromax 500mg cost
order valacyclovir 1000mg for sale – starlix 120 mg canada generic zovirax 800mg
ivermectin 3mg pills – ceftin pill sumycin 500mg cost
ivermectin stromectol – buy sumycin buy generic sumycin for sale
ciplox 500mg for sale – buy erythromycin 500mg generic order erythromycin 250mg sale
brand ciprofloxacin – buy clavulanate cheap amoxiclav medication
proscar 1mg cost order diflucan 200mg pill buy forcan
ampicillin antibiotic buy penicillin generic order amoxicillin online
buy simvastatin generic buy valtrex 500mg without prescription order valacyclovir 500mg generic
buy dutasteride buy generic dutasteride for sale purchase ranitidine online
order zofran 8mg for sale buy aldactone buy spironolactone 25mg sale
buy sumatriptan generic buy sumatriptan generic buy levofloxacin 250mg pill
order tamsulosin buy generic celebrex 100mg buy celebrex 200mg pills
purchase esomeprazole generic buy esomeprazole 20mg order topiramate for sale
maxolon cost buy losartan 25mg pills losartan brand
order methotrexate 10mg buy coumadin paypal warfarin 2mg ca
cheap essay writer college essay service research paper website
propranolol sale buy inderal online order clopidogrel pills
depo-medrol online buy methylprednisolone brand medrol oral
buy orlistat online oral xenical 60mg order diltiazem for sale
order glucophage 500mg generic buy glycomet metformin 1000mg oral
purchase dapoxetine without prescription buy dapoxetine 90mg generic buy misoprostol pills for sale
buy chloroquine pills order chloroquine without prescription chloroquine pill
buy generic loratadine over the counter loratadine oral buy generic loratadine 10mg
order cenforce 50mg without prescription order cenforce pill generic cenforce 50mg
buy desloratadine pills buy desloratadine 5mg generic order clarinex 5mg online
buy hydroxychloroquine for sale hydroxychloroquine 200mg ca buy hydroxychloroquine 400mg generic
buy lyrica paypal buy lyrica generic pregabalin 150mg canada
purchase levitra generic order vardenafil 10mg sale levitra 20mg price
online blackjack with real money play online roulette for fun play money poker online
rybelsus order rybelsus 14 mg pills rybelsus 14 mg tablet
monodox for sale online cheap doxycycline purchase vibra-tabs generic
order sildenafil 50mg without prescription cheap sildenafil tablets buy viagra 50mg online cheap
order furosemide without prescription order furosemide 100mg lasix 100mg uk
clomid 50mg ca buy cheap generic clomiphene buy generic clomid
buy neurontin cheap purchase neurontin generic buy neurontin
cheap synthroid sale cheap levoxyl tablets purchase levoxyl pills
purchase prednisolone online cheap order omnacortil 5mg online cheap prednisolone 40mg oral
augmentin brand buy augmentin 625mg without prescription order augmentin generic
buy cheap azithromycin zithromax online zithromax 250mg brand
buy asthma pills ventolin price buy asthma pills onlin
buy generic amoxicillin order amoxicillin for sale order amoxil 250mg without prescription
cost rybelsus 14 mg buy semaglutide 14 mg for sale rybelsus 14 mg tablet
purchase isotretinoin pill isotretinoin 10mg pill buy isotretinoin 10mg online cheap
rybelsus 14mg brand buy rybelsus 14 mg for sale order rybelsus 14mg generic
deltasone 10mg pill deltasone 5mg over the counter buy prednisone 5mg without prescription
brand tizanidine buy zanaflex generic purchase tizanidine generic
clomiphene 50mg usa clomid order online order clomid 50mg pills
buy levitra 10mg without prescription vardenafil 10mg without prescription
levoxyl cheap generic synthroid 75mcg order levothyroxine sale
buy generic augmentin augmentin 625mg uk
ventolin pill order ventolin generic order albuterol 2mg online cheap
order monodox without prescription buy generic doxycycline
generic amoxicillin 250mg amoxicillin 1000mg us amoxicillin tablets
buy cheap generic omnacortil buy generic omnacortil over the counter order prednisolone 10mg pills
order lasix 100mg for sale furosemide pills
azipro medication azipro 250mg without prescription azithromycin uk
buy neurontin generic neurontin 600mg uk
zithromax brand buy zithromax 500mg online azithromycin 250mg cost
sleeping pills for sale uk buy generic phenergan 25mg
buy generic amoxicillin 250mg buy amoxil pill buy amoxil 250mg pills
accutane 10mg for sale cost accutane isotretinoin where to buy
drugs for chemo induced nausea ciprofloxacin 500mg us
order acne pills buy betnovate 20gm generic prescription strength acne treatment
best medication for gerd symptoms generic glimepiride 4mg
prednisone 10mg sale prednisone 40mg canada
buy sleeping tablets online usa provigil for sale online
can flonase make you sleepy allergy medications for itching skin prescription allergy medication without antihistamines