ইতিহাস থেকে বাইবেলে – সাইরাস দ্য গ্রেট
বাইবেল সম্বন্ধে যাদের জানাশোনা আছে তাদের কাছে সাইরাস একটি সুপরিচিত নাম। তবে তার ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা বাইবেলে পাওয়া যায়না। তাই আজকের আয়োজনে আপনাদের জানাব সেই বিখ্যাত সাইরাস দ্য গ্রেটের জীবনী যিনি মেধা, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার মাধ্যমে ইতিহাস থেকে স্থান করে নিয়েছিলেন বাইবেলে।
সাইরাস দ্য গ্রেট যিনি সাইরাস–২ নামেও পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯০-৫৮০ সালে মেডিয়া বা পার্সিয়ায় (বর্তমানে ইরান) জন্মগ্রহণ করেন এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৯ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি একজন রাজ্য বিজেতা এবং আকেমেনিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। তার সাম্রাজ্য একদিকে মধ্য পারস্য থেকে নিকট প্রাচ্য এবং অন্যদিকে পূর্বে এজিয়ান সাগর থেকে ইন্দু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তাকে পারস্যে সাইরাসদের কিংবদন্তী হিসেবেও স্মরণ করা হয়। গ্রীক সৈন্য ও লেখক জেনোফোনের সাইরোপেডিয়াতে সর্ব প্রথম সাইরাস দ্য গ্রেটের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে তিনি সাইরাস দ্য গ্রেট কে একজন আদর্শ শাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনা থেকে আরও জানা যায় যে, প্রাচীন পারস্যের সাধারণ জনগণ তাকে পিতৃতুল্য সম্মান করতেন। খ্রিষ্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে ব্যাবিলনে বন্দি খ্রিষ্টানদের মুক্ত কারী হিসেবে সাইরাস দ্য গ্রেটের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা আছে।
জীবন এবং কিংবদন্ত
সাইরাস দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯০ অথবা ৫৮০ অব্দে হয় মেডিয়া অথবা পারসিসে জন্মগ্রহণ করেন যা বর্তমানে ইরানের ফার্স প্রদেশে অবস্থিত। তার নামের ব্যাপারে একটি মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের মতে সাইরাস তার জন্মগত নাম আবার অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন এটি তার আসল নাম নয় বরং তিনি শাসক হওয়ার পরে তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তবে এটি সত্য যে আকেমেনিয়া সাম্রাজ্যের পতনের পর এই নাম আর ইরান সম্বন্ধীয় অন্য কোথাও ব্যবহৃত হয়নি।
একটি ব্যাপারে অনেক ইতিহাসবেত্তা ই একমত যে সাইরাসের নাম পারস্যে আগেও একজন শাসক ছিলেন। তবে এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে সাইরাস দ্য গ্রেট একটি সম্ভ্রান্ত শাসক গোষ্ঠী থেকে এসেছিলেন।
তার জীবনের সবচে উল্লেখযোগ্য তথ্য গুলো পাওয়া যায় বিখ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের কাছ থেকে। বিভিন্ন প্রাচীন শাসকদের জীবনী নিয়ে জেনোফোনের (গ্রীক ইতিহাসবিদ ও সেনাপতি) লেখনীর মাধ্যমেও সাইরাস দ্য গ্রেটের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। হেরোডোটাস জানান যে, পারস্যের লোকেরা সাইরাসকে তাদের পিতা হিসেবে মান্য করত কিন্তু পরবর্তী আকেমেনিয় শাসকরা তার ধারা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।
সাইরাসের শৈশবের বর্ণনা দিতে গিয়ে হেরোডোটাস এবং জেনোফোন প্রায় একই ধরণের তথ্য দেন। তাদের মতে জন্ম থেকেই সাইরাস অন্য দশ জন সাধারণ শিশুর থেকে অনেক আলাদা ধরনের ছিলেন তাই রাজ্যের সাধারণ মানুষ তাকে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন দেবশিশু বলে মনে করত।
কথিত আছে পারস্যের জমিদার ও মেডাসের রাজা আস্তাগেস তার কন্যাকে পার্সিসে স্যাম্বিসেস নামে তার একজন সামন্তের সাথে বিয়ে দেন এবং তাদের ঘরে জন্ম নেন সাইরাস। আস্তাগেজ একদিন স্বপ্নে দেখেন তার কন্যার ঘরে জন্ম নেওয়া ছোট বালকটি একদিন বড় হয়ে তাকে রাজ্যচ্যুত করছে। এই স্বপ্ন দেখে তিনি খুব ভীত হন এবং সাইরাসকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।
তার হুকুম প্রাপ্ত জল্লাদ বালকটির দিকে তাকিয়ে তার প্রতি খুব মায়া অনুভব করেন এবং তাকে হত্যা করার পরিবর্তে একটি মেষ পালকের নিকট দিয়ে দেন। দশ বছর বয়সে সাইরাসের বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে এক সময় আস্তাগেসের কানেও পৌঁছে যায় এবং তিনি তার দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে সাইরাসকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেন। পার্সিসে কিশোর সাইরাস নির্ঝঞ্ঝাটে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে থাকে। সাইরাস যখন যৌবন প্রাপ্ত হন তখন তিনি তার অত্যাচারী জমিদার নানার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আস্তাগেসের বাহিনী সাইরাসকে রুখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ সালে সাইরাসের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়।
সাইরাসের বিজয়
মেডাসে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর প্রথমেই সাইরাস ইরানের বিভিন্ন গোত্রকে একত্রিত করে তার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তারপর পশ্চিমের দিকে ধাবিত হতে থাকেন। আস্তাগেসের পতনের পর তার নাতি সাইরাসের সিংহাসন আরোহণ এবং লিডিয়ার দিকে তার অগ্রসরের সংবাদ শুনে এশিয়া মাইনর অঞ্চলের লিডিয়ার রাজা ক্রোয়েসাস মেডাসকে কর দেয়া বন্ধ করে নিজের রাজ্য বিস্তৃতি শুরু করেন। এ ঘটনায় সাইরাস ক্ষুব্ধ হয়ে লিডিয়া আক্রমণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৭ অথবা ৫৪৬ সালে লিডিয়ার রাজধানী সারদিসের পতন হয় এবং ক্রোয়েসাস কে হয় হত্যা নতুবা তিনি আগুনে আত্মাহুতি দেন। যদিও অন্য কিছু উৎস থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে তাকে সাইরাস যুদ্ধবন্দি করেছিলেন এবং তার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করেছিলেন।
লিডিয়ার রাজার অধীনস্থ এজিয়ান সমুদ্র উপকূল অঞ্চলের শহর গুলোর সামন্তরা ক্রোয়েসাসের পরাজয়ের পর সাইরাসের অধীনস্থ হয়। তারা কেউই প্রথমে সাইরাসের শাসনকে মেনে নিতে রাজি হননি কিন্তু তাদের সকল বিদ্রোহকে সাইরাস কঠোর হস্তে দমন করে অধীনস্থ করেন। এরপর সাইরাস ব্যাবিলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেখানকার শাসক নাবোনিদাসকে নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে এমন অজুহাতে তিনি নিম্নাঞ্চল আক্রমণ করেন। তিনি এখানে খুব দ্রুত সাফল্য লাভ করেন এবং ব্যাবিলনকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার নগর ব্যাবিলন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারস্যের অধিভুক্ত হয়।
ব্যবিলনে বন্দী ইহুদীদের মুক্ত এবং তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দেয়ার জন্য বাইবেলে সাইরাসের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ রয়েছে। সাইরাস ব্যবিলনীয় ও অন্যান্যদের ব্যাপারেও বেশ সহনশীল ছিলেন। তিনি স্থানীয় প্রচলিত প্রথার সমর্থন এবং স্থানীয় দেবদেবীদেরকে সম্মান করার মাধ্যমে দ্রুত স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেন।
ব্যবিলন বিজয় সাইরাসের হাতে শুধুমাত্র যে মেসোপটেমিয়াকে এনে দিয়েছিল তা নয় বরং পূর্বে ব্যাবিলনের দখল করা সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন ও সাইরাসের অধীনে চলে আসে। পরবর্তীতে আবার ক্রোয়েসাস আক্রমণের সময় সিলিসিয়ার শাসক সাইরাসের মিত্র হন এবং পরবর্তীতে তিনি সাইরাসের সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। দক্ষ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কূটনৈতিক দক্ষতা সাইরাসকে সমসাময়িক সময়ে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল।
সাইরাস একই সাথে একাধিক রাজধানীর মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। একটি ছিল একবাতানা শহরে, বর্তমানে যা হামাদান এবং পূর্বে তা মেডাসের রাজধানী ছিল। এবং অন্যটি ছিল তার সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী পাসারগাদ যার অবস্থান ছিল পারস্যে। কথিত আছে এই স্থানে সাইরাস তার নানা আস্তাগেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হন এবং তার সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয় এখান থেকে তাই এই স্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। এছাড়াও সাইরাস শীতকালীন রাজধানী হিসেবে ব্যাবিলনকে ব্যবহার করতেন।
পারস্য এবং মেডাসের মানুষজনদের মধ্যে সাইরাস আচরণগত পার্থক্য লক্ষ করেন। তিনি দেখেন পারস্যের বিভিন্ন গোত্র প্রায় বিনা বাধায় তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে। তাদের মাঝে কোন উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা নেই। তাই তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার জন্য মেডাসকে শুধু পারস্যের সাথে একীভূতই করেননি বরং তিনি এই দুই জাতির মানুষের জন্য দ্বৈত রাজতন্ত্র চালু করেন। সাইরাস মেডাসবাসীদের কাছ থেকে শাসক হবার শিক্ষা লাভ করেন যারা সবসময় শাসন করত এবং পারস্যবাসীদের কাছে সহনশীল হওয়ার শিক্ষা লাভ করেন যারা তাদের সামন্ত হিসেবে কাজ করত।
সাইরাসের কৃতিত্ব ও শেষ জীবন
এটি আকেমেরিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার সামর্থ্যের একটি সাক্ষ্য যে এটি তার মৃত্যুর পরেও সাম্রাজ্য প্রসারণ অব্যাহত ছিল এবং তা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে। সাইরাস শুধু একজন মহান বিজয়ী এবং প্রশাসকই ছিলেন না; তিনি ইসরায়েলীদের জন্য রোম বা মুসা রোমুলাস এবং রেমাসের মত ফার্সি মানুষের মনেও স্থান করে নিয়েছিলেন। প্রাচীন বিশ্বের যোদ্ধা ও বিজয়ীদের মধ্যে তার কাহিনী কিংবদন্ত ছিল এবং তারা সাইরাসের জীবনী অনুসরণ করতেন।
যেভাবে বাচ্চা সাইরাসকে মেষপালকের কাছে দেওয়া হয়েছিল সেটি মিশরের মুসার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তার অত্যাচারী নানার উৎখাত অন্যান্য কল্পবিজ্ঞান ও কিংবদন্তিগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। কোন সন্দেহ নেই যে, প্রথমে পারস্যে সাইরাসের কাহিনী শুরু হয়েছিল এবং এটি গ্রীকদের কাছেও সুপরিচিত ছিল। সাইরাসের মৃত্যু কাহিনী নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তার স্ত্রী টোমিরাস ইহুদী বন্দিত্বের ৬০ তম বছরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩০ সালের ৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করেন।
order generic semaglutide – purchase glucovance order DDAVP for sale